AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয় 


বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয় 

দেশের পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের রেকর্ড বন্যা দেখলাম আমরা।এই আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষের জনস্বাস্থ্য। পানি নেমে যাওয়া শুরু হলেই ডায়রিয়াসহ নানান পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে আসবে।

১১টি জেলার ৭৭টি উপজেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। পানিবন্দী হয়েছে ১০ লাখের বেশি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫০ লাখের বেশি মানুষ। ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ অনেক জেলায় স্বাস্থ্যকাঠামোগুলোও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যায়। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়া দুরূহ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে দুর্গত এলাকায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।প্রিয় পাঠক, বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগ থেকে দূরে থাকার উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

পানি ফুটিয়ে নেওয়া-

পানি থেকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য পরজীবীর মতো ক্ষতিকারক রোগজীবাণু নির্মূল করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে পানি ফুটানো। এর জন্য কমপক্ষে এক মিনিট থেকে সর্বোচ্চ তিন মিনিট পর্যন্ত পানি গরম করা উচিৎ। অতঃপর ঠান্ডা করে পান করা সহ প্রয়োজনীয় কাজে এই পানি ব্যবহার করা যাবে। ফুটানোর বিকল্প হিসেবে পানি পরিশোধন ট্যাবলেট বা পানির ফিল্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এগুলোর থেকে ফুটানোর মাধ্যমেই সবচেয়ে কার্যকরীভাবে জীবাণু নির্মূল হয়। সর্বতভাবে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বন্যার পর ডায়রিয়া বা কলেরার সংক্রমণ থেকে দূরে থাকা যায়।

বন্যার পানি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা-

পয়ঃনিষ্কাশন, রাসায়নিক পদার্থ এবং অন্যান্য আবর্জনার কারণে বন্যার পানি দূষিত হয়। প্লাবিত রাস্তাঘাটে যাতায়াতের সময় এবং ঘরবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়লে হরহামেশাই মানুষ এই দূষিত পানির সংস্পর্শে আসে। আর এ থেকেই তৈরি হয় নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বন্যার পানিতে থাকে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, যা বিভিন্নভাবে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। তাই সংস্পর্শ যতটা সম্ভব কমানোর জন্য পানিরোধী বুট এবং গ্লাভ্স পরা যেতে পারে। এছাড়া সংস্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই সাবান এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে সংস্পর্শে যাওয়া শরীরের স্থানটি ভালভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই সাবধানতা ত্বকের সংক্রমণের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করে।

ঘরবাড়ির মেঝে জীবাণুমুক্ত করা-

অতিরিক্ত বন্যায় দূষিত পানি বাড়ির আঙ্গিনা সহ ঘরের ভেতরে ঢুকে যেয়ে সর্বত্রে রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। গ্রামের ঘরবাড়ি এবং শহরের নিচ তলার বারান্দা ও ঘরগুলো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাই বাড়ির চারপাশ সহ ঘরের মেঝে, ফার্নিচার, দরজার হাতল এবং পানির কলগুলো জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক। এর জন্য এক গ্যালন পানিতে এক কাপ পরিমাণ ব্লিচ মিশিয়ে তৈরিকৃত দ্রবণ দিয়ে স্থানগুলো মুছতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলার আগে দ্রবণটিকে কমপক্ষে ১০ মিনিটের জন্য ভালভাবে মিশতে দিতে হবে। এ সময় হাতে ডিস্পোজেবল গ্লাভ্স পরতে হবে, আর ধোয়া-মোছার সময় জানালা খুলে দিয়ে ঘরে বায়ুচলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

শুকনো খাবার, পানি ও চিকিৎসা সামগ্রী সংরক্ষণ-

ভারী বর্ষণে এবং পরবর্তীতে বন্যার সময় দীর্ঘ সময় যাবৎ পানিবন্দি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থায় তাৎক্ষণিক ভাবে খাদ্যসামগ্রী, খাবার পানি এবং ঔষধপত্র সংগ্রহের উপায় থাকে না। তাই আগে থেকেই মুখবন্ধ পানিরোধী পাত্রে জরুরি খাবার এবং খাবার পানি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। টিনজাত এবং শুকনো খাবারের মতো অ-পচনশীল খাবার বা যেগুলোর জন্য খুব বেশি রান্নার প্রয়োজন হয় না এমন খাবার জমিয়ে রাখতে হবে। পানীয় এবং স্যানিটেশনের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত পানি সঞ্চয় করতে হবে। সঞ্চয়ের তালিকায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকারি প্রতিটি ঔষধও রাখতে হবে।

বর্জ্য অপসারণ-

নর্দমা এবং বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সামগ্রী বা ধ্বংসস্তূপের ময়লা-আবর্জনার যথাযথ নিষ্পত্তি দরকার। বর্জ্যের জন্য নির্দিষ্ট বিন ব্যবহার এবং তা সময়মতো অপসারণ করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ধোঁয়া ছড়াতে পারে এমন পোড়া উপকরণগুলোর নিষ্পত্তির সময় যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। সিটি করপোরেশনের নিয়োজিত আবর্জনা সংগ্রহকারী কর্মীরা যথাসম্ভব দ্রুত বর্জ্য অপসারণে সক্রিয় থাকছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই বিষয়ে এলাকার সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কেননা অব্যবস্থাপনার শিকার হওয়া বর্জ্য হেপাটাইটিস ই এবং গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়।

বৃষ্টির পানি কাজে লাগানো-

বন্যার সময় যখন পানির প্রায় সব কৃত্রিম উৎসগুলো দূষিত হয়ে যায়, তখন বৃষ্টির পানি হতে পারে সব থেকে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। খোলা জায়গায় মুক্ত ভাবে পড়ন্ত বৃষ্টির পানি সরাসরি একটি পরিষ্কার পাত্রে সংগ্রহ করা যায়। যেখানে এই সুযোগ নেই সেখানে পানি সংগ্রহের পর তা একটি পরিষ্কার কাপড়ের মাধ্যমে ফিল্টার করতে হবে। অতঃপর কমপক্ষে এক মিনিট সিদ্ধ করে যাবতীয় রোগজীবাণু মেরে ফেলতে হবে।

ঘরে উন্মুক্ত বায়ুচলাচল বজায় রাখা-

বন্যা বা ভারী বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে ঘরের বদ্ধ স্যাঁতসেঁতে ভাব দূর করতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় বদ্ধ ঘরের মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে দুর্বল ফুসফুস বা শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের এটি স্বাস্থ্য জটিলতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই সমস্ত জানালা খুলে দিতে হবে যেন, ভেতরের বাতাস বাইরে বের হতে এবং বাইরের বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারে। এছাড়া ঘরের আর্দ্রতা কমাতে বৈদ্যুতিক ফ্যান এবং ডিহিউমিডিফায়ারও ব্যবহার করা যায়। এ সময় ঘরের ভেতর দীর্ঘক্ষণ যাবৎ কোনো ভেজা কাপড় না রাখাই ভাল। পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল শুধুমাত্র ঘরের আভ্যন্তরীণ পরিবেশকে শুষ্কই করে না বরং বাতাসকে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুর বৃদ্ধি লাভের অনুপযোগী করে তোলে।

পানি সরবরাহ লাইনের ছিদ্র দ্রুত মেরামত করা-

পানি দূষণ রোধের পাশাপাশি যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে বাড়ির পানি সরবরাহের লাইনে কোনো ছিদ্র আছে কিনা সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। ছাদে পানির ট্যাঙ্কি ও এর সঙ্গে সংযুক্ত পাইপ, এবং বাড়ির কলগুলোর কোনোটিতে ফাটল বা ছিদ্র আছে কিনা তা সুক্ষ্ম ভাবে যাচাই করতে হবে। কেননা এগুলোর যে কোনো একটি যথেষ্ট ঘরের ভেজা পরিবেশকে আরও স্যাঁতসেঁতে করে তোলার জন্য। পানিরোধী সিল্যান্ট বা প্যাচের মতো উপযুক্ত উপকরণ ব্যবহার করে এই লিকগুলোকে দ্রুত মেরামতো করে ফেলতে হবে।

ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) ব্যবহার-

বন্যার মতো দুর্যোগের মুহুর্তে ডায়রিয়া এবং অন্যান্য অসুস্থতার কারণে পানিশূন্যতার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই সমস্যা নিরসণের দারুণ একটি উপায় হতে পারে ওআরএস ব্যবহার। এটি ডিহাইড্রেশন-সম্পর্কিত জটিলতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।

প্রতি প্যাকেট ওআরএসের জন্য এক লিটার অথবা পাঁচ কাপ পরিষ্কার পানি সিদ্ধ করতে হয়। পানি সিদ্ধ হয়ে গেলে তা হাল্কা গরম হওয়ার জন্য রেখে দিতে হবে। তারপর সমস্ত ওআরএস পাউডার পানিতে ঢেলে তা সম্পূর্ণ দ্রবীভূত না হওয়া পর্যন্ত মিশ্রণটি নাড়তে হবে। সম্পূর্ণ মিশে যাওয়ার পর তৈরি ওআরএস একটি পরিষ্কার কাপে নিয়ে পান করা যেতে পারে।

আবার বন্যায় অনেক মৃত প্রাণী পচে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশকে দূষিত করে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। মৃতদেহ মাটির তিন মিটার নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। খালি হাতে মৃতদেহ ধরা যাবে না। মানুষ ও গবাদি পশুপাখির মলমূত্র নিরাপদে সরিয়ে নিতে হবে। মলমূত্র ত্যাগের জন্য অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা করা যেতে পারে। বন্যার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ফিটকিরি, মশার কয়েল, স্যালাইন, সাবান, ডেটল ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরকারি ও বেসরকারিভাবে সরবরাহ করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি মানুষ ও ভেটেরিনারি স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা প্রদান করা প্রয়োজন।বন্যার সময় সাপ ও ইঁদুর তাদের আবাস হারিয়ে শুকনো স্থানে মানুষ ও গবাদি পশুপাখির সঙ্গে অবস্থান নেয়। এ জন্য সাপ ও ইঁদুরে কাটার পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষহীন সাপে কাটলে ভয়ের কিছু নেই। তবে বিষধর সাপে কাটলে সাপে কাটা স্থানের সামনে মোটা কাপড় বা গামছা বা রশি দিয়ে দিয়ে গিঁট দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে অ্যান্টিভেনম এবং টিটেনাস প্রতিষেধক দিতে হবে। ইঁদুরে কাটলেও অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই , বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি কমাতে এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা জরুরি। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সামগ্রী সংরক্ষণ, সঠিক বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং বৃষ্টির পানি ব্যবহার যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

অন্যদিকে বন্যাগ্রস্ত অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব পানি বিশোধন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, ঘরে বায়ু চলাচল বজায় রাখা ও পানির ক্ষতিগ্রস্ত উৎসগুলো মেরামত করা অপরিহার্য। উপরন্তু, যাবতীয় সতর্কতার পরেও যে কোনো জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে নিরাপদ রাখতে হলে উপরের পরামর্শগুলো মেনে চলতে হবে এবং যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে হাতুড়ে ডাক্তার বা অনলাইন ভিত্তিক অনির্দিষ্ট আলোচনার উপর ভিত্তি না করে উপযুক্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এসময় পারিবারিক পর্যায়ে মানসিক সমর্থন ও সান্ত্বনা প্রদান এবং একে-অপরের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ধীরে ধীরে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে হতাশ না হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আর যথেষ্ট পরিমাণ সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান ও পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ,জাতীয়  রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

কলাম লেখক ও গবেষক, ইমেইল,[email protected]

মোবা.০১৮২২৮৬৯৩৮৯

 

একুশে সংবাদ/বিএইচ

Link copied!