বিশ্ব প্রাণী দিবস আজ (৪ অক্টোবর) ২০২৪। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রাণীদের কল্যাণের মাধ্যমে তাদের অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে দিবসটি বিশ্বে পালিত হয়।আর বিশ্ব প্রাণী দিবস পৃথিবীর প্রাণীকূলকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিবসটির সূচনা করা হয়। মানুষের খাদ্য শৃংখল কে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণী দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।প্রাণী আল্লাহর একটি মূল্যবান উপহার। ‘প্রাণী’ শব্দটি বলতে শুধু প্রাণীদেরই নয়, বরং পাখি, পোকামাকড়, গাছপালা, ছত্রাক, এমনকি অতিক্ষুদ্র প্রাণীসহ সব প্রাণবন্ত জীবনোপকরণকে বোঝায়।
এ পৃথিবীতে একটি সুস্থ পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্রাণীর গুরুত্ব অনেক। প্রতিটি প্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খলে এক অনন্য জায়গা রয়েছে, যা বাস্তুসংস্থান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অবদান রাখে। কিন্তু বর্তমানে অনেক প্রাণী ও পাখি বিপন্ন হচ্ছে।
এই পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের যেকোনো একটি প্রাণীর অনুপস্থিতির কারণে পুরো বাস্তুসংস্থানের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এর ফলে পৃথিবীতে মানুষের উপর অতিরিক্ত প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকের ধারণা। তাই প্রত্যেকটি প্রাণীকে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার এবং অবাধ বিচরণের আমাদের সুযোগ করে দিতে হবে। এই সচেতনতাবোধ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্ব প্রাণী দিবস এর সূচনা করা হয়।
> বিশ্ব প্রাণী দিবস কবে?
বিশ্ব প্রাণী দিবস পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো প্রাণী আছে সবগুলোরই সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুষ্ঠুভাবে বংশবৃদ্ধি করার অধিকারের কথা মাথায় রেখে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর জন্য প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে বিশ্ব প্রাণী দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
> বিশ্ব প্রাণী দিবসের ইতিহাস ও বিভিন্ন বন্যপ্রাণী:-বিশ্ব প্রাণী দিবস সর্বপ্রথম হেনরিক জিম্মারমেন নামের একজন জার্মান লেখক ও প্রকাশক মেন্স উন্ড হুন্দ (মানুষ ও কুকুর) নামের একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রথম ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জার্মানির বার্লিন স্পোর্ট প্যালেসে এই দিবস উদযাপন করেন। সেখানে ৫ হাজারের অধিক মানুষ অংশ নেন।
১৯২৯ সালে প্রথমবারের মতো এই দিবসটি ৪ অক্টোবর পালন করা হয়। প্ৰথমদিকে তিনি কেবল এ দিবসে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়ার অনুসারী পেয়েছিলেন। বিশ্ব প্রাণী দিবস জনপ্রিয় করতে জিম্মারমেন নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। অবশেষে, ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রাণী সুরক্ষা কংগ্রেসে তার উত্থাপন করা প্রস্তাব মতে, ৪ অক্টোবরকে বিশ্ব প্রাণী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বৰ্তমানে বিশ্ব প্রাণী দিবস একটি বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রাণী কল্যাণ চ্যারিটি নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে।বিশ্ব প্রাণী দিবসের আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের মতে, এ দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রাণীদের কল্যাণের মাধ্যমে তাদের অবস্থার উন্নতি করা। বিশ্ব প্রাণী দিবস উদযাপনের মাধ্যমে প্রাণী কল্যাণ আন্দোলনকে একত্রিক করা, একে আন্তর্জাতিকভাবে জোরদার করে পৃথিবীকে প্রতিটি জীবের জন্য উন্নততর বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলা। জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে দিবসটিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালন করা হয়।নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল আমাদের এই বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন-২০০০) তথ্যমতে, এ দেশে প্রায় ২২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির পাখি এবং ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন`র এক জরিপের তথ্য থেকে জানা যায়, গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৩০০ প্রজাতির প্রাণী। দেড়শ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৩ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় তিনশ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও আছে বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।এসব প্রাণী দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে। বন্যপ্রাণীরা আমাদের অনেক উপকারে আসে। এ দেশে কিছু বন্যপ্রাণী আছে, যেগুলো বিভিন্নভাবে পরিবেশের ও আমাদের উপকার করে থাকে। এ রকম কিছু প্রাণী-
কেঁচো : কেঁচো সাধারণত নরম ও ভেজা মাটির উপরের স্তরে গর্ত করে বসবাস করে। এরা মূলত মাটির সঙ্গে মিশে থাকা পচা পাতা, পতঙ্গের ডিম, লার্ভা, মৃত পোকার দেহাংশ এবং বিভিন্ন জৈব বস্তু খেয়ে থাকে। কেঁচো মাটি খুঁড়ে মলত্যাগের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ বের করে ‘কেঁচো কম্পোস্ট’ তৈরি করে। এই সার যেহেতু পরিবেশবান্ধব এবং দামে কম তাই এর ব্যবহার পরিবেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।
ব্যাঙ : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাঙের গুরুত্ব অনেক। ব্যাঙ ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। খাদ্য শৃঙ্খলে ব্যাঙ মধ্যম স্তরের প্রাণী। ব্যাঙ ডেঙ্গু, গোদ রোগ, কলেরা, টাইফয়েড, অ্যানথ্রাক্স ও ম্যালেরিয়ার মতো শত শত রোগবাহী কীটপতঙ্গ খেয়ে এসব রোগকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়াও ব্যাঙ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতেও সক্ষম। বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতি প্রায় ৬৩টি।
চড়ুই : চড়ুই পাখি প্রধানত অসংখ্য পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বিশেষ করে পোকার শুককীট, মুককীট বা লেদাপোকা, যা শস্য উৎপাদন ব্যাহত করে। চড়ুই পাখি এসব পোকার ক্ষতিকর আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করে এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
শকুন : শকুনের একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। একে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলা হয়ে থাকে। নানা ধরনের পচা ময়লা-আবর্জনা খেয়ে রোগ-জীবাণুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে শকুন। এরা শিকারি পাখি নয়, শুধু মৃত প্রাণীই খেয়ে থাকে। দিন দিন এই উপকারী পাখিটি মানুষের অসচেতনতা ও অবহেলায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বোলতা : বোলতাকে ভিমরুল নামেও ডাকা হয়। এরা ক্ষতিকারক মথ বা মাজরাজাতীয় পোকার ডিম নষ্ট করে ফেলে। বোলতা অন্য পোকামাকড়ের শুককীটের মধ্যে ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম থেকে জন্ম নেয়া বোলতা কীটগুলো অন্য পোকার শুককীটগুলো খেয়ে বড় হয়। কৃষিজ পতঙ্গ নিবারণে বোলতা অনেক সহায়তা করে।
মৌমাছি : মৌমাছি একটি পরিচিত উপকারী পতঙ্গ। এরা মূলত ক্ষুদ্র ও পরিশ্রমী। মৌমাছি থেকে আমরা মোম ও মধু পাই। মধু উৎপাদনের জন্য মৌমাছি বাক্সবন্দি করে চাষ করা হয়, যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
মোম, মোমবাতি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ওষুধ ও প্রসাধনী যেমন- স্নো, কোল্ড ক্রিম, সেভিং ক্রিম তৈরিতে মধু ব্যবহৃত হয়। মৌমাছি ফুলের পরাগায়নের মাধ্যমে কৃষিজ ও বনজ গাছপালার ফলন ও গুণগতমান বৃদ্ধি করে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে প্রাকৃতিক সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার, পর্যাপ্ত সংরক্ষণের অভাব, ঘূর্ণিঝড় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে, যার পরিণামে অনেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
‘ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ’ নামক বন্যপ্রাণী বিষয়ক সংগঠনের তথ্যমতে, আবাসস্থল ধ্বংসের ফলে ১৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রায় অর্ধেক প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। গণ্ডার, নীলগাই, ডোরাকাটা হায়েনা, বন্য মহিষ, ময়ূর, হাড়গিলা, জলার কুমির, জলার হরিণ ইত্যাদি বর্তমানে বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণী।
এছাড়াও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, বনগরু, ডোরা কাঠবিড়ালি, সাম্বার হরিণ, কালো ভালুক ইত্যাদি বন্যপ্রাণী এখন বিলুপ্তপ্রায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নতি করতে না পারলে আগামী কয়েক দশকে মোট বন্যপ্রাণী প্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিলুপ্তি হতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাণীদের প্রতি মর্যাদা এবং তাদের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মান বৃদ্ধি করা এবং সর্বোপরি বিশ্বকে সব প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য ও জীবনধারণে সহায়ক সুপরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে দিবসের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। তাই বিশ্বের ৬০ ভাগের বেশি রোগের সৃষ্টি হয় প্রাণি থেকে। প্রাণির বিষয়ে সচেতন থেকে এ রোগবালাই থেকে বাঁচা সম্ভব। আর এ কারণেই প্রাণির বিষয়ে সচেতন হতে হবে ও তাদের রক্ষার্থে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাণিদের সঠিক পরিবেশে রাখা ও তাদের যত্ন নিতে সবাইকে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।আর জলবায়ু ও সার্বিক পরিবেশ প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্যও দিবসটি পালন করা ও দিবসের মাহাত্ম উপলব্ধি করে বিভিন্নমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :