সাধারনত আইন পেশার সাথে যারা জড়িত আছেন তারা ছাড়া আমরা অধিকাংশ লোকজনই থানার মামলা তথা এজহার বা এফ আই আর সম্পর্কে ধারনা কমই থাকে। প্রকৃতপক্ষে দেশের নাগরিকের নিরাপত্তা রক্ষা ও বিচার প্রশাসনের একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ হচ্ছে পুলিশ বা থানা। আসুন সংক্ষেপে থানায় দায়েরী মামলা বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক, যদিও পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে তাই মুল বিষয়ে আলোচনা। বিশেষ করে ছাত্র জনতার আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি ঘটনার প্রেক্ষিতে থানায় দায়েরী মামলা সম্পর্কে ধারনা প্রদানের লক্ষ্য এই আলোচনা করা হলো।
এজহার ও FIR কি ?
সহজ কথায়, অপরাধ বা অপরাধমূলক কোনো কিছু ঘটার পর সে বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার জন্য থানায় যে সংবাদ দেওয়া বা জানানো হয়, তাকে এজাহার বা এফআইআর(ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) বলে। প্রকৃতপক্ষে, এজাহারের মাধ্যমে থানায় মামলা করা হয়। কারণ রাস্ট্র পক্ষের যে কোন মামলার আইনি প্রক্রিয়ার শুরু হয় এই এজহারের মাধ্যমে । অর্থাৎ যে কোন মামলার প্রথম ধাপ হল এই এজহার। থানায় এজহার দায়ের করার পর সংশ্লিষ্ট থানার ওসি এজহারটি ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আদালতের বরাবর প্রেরন করে থাকেন। অতপর আদালত এজহারটি দেখে উক্ত এজহার ও এফআইআর টি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ওসি কে নির্দেশ দিয়ে একটি তারিখ নির্ধারন করে দেন। এভাবে যতদিন তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা না হবে ততদিনই আদালতে পরবর্তী তারিখ নির্ধারন করতে থাকবেন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলে আদালত পরবর্তী বিচারকাজ শুরু করেন।
এফ আই আর দায়েরের পরে পুলিশ এর দায়িত্ব :
এফ আই আর দায়ের করার পর যদি উল্লিখিত অপরাধ আমলযোগ্য কিংবা এমন কোনো ঘটনাসংক্রান্ত হয়, যা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলে আসামিদের ধরা যাবে বা শনাক্ত করা যাবে, বা করা উচিত, সে ক্ষেত্রে পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেবে বা ঘটনার তদন্ত করবে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই ( ফৌ.কা. ধারা: ১৫৬) আর যদি, এজাহারে বর্ণিত অপরাধ বা বিষয়টি আমলযোগ্য না হয়, তবে পুলিশ এ- সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাখিল করবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বা তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অনুমতি নেবে । ( ফৌ.কা. ধারা: ১৫৫) উভয় ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি নিম্নোক্ত ধাপগুলো সাধারণত পালন করে থাকেন;
(ক) ঘটনাস্থলে যাওয়া।
(খ) মামলার ঘটনা এবং অবস্থা। ascertain করা বা অবগত হওয়া।
(গ) সন্দেহভাজন অপরাধী বা অপরাধীদের বের করা এবং গ্রেপ্তার করা।
(ঘ) অভিযুক্ত অপরাধ সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করা। যেমন: সংশ্লিস্ট ব্যক্তিসহ অন্য ব্যক্তিবর্গের বিবৃতি নেয়া ও জিজ্ঞাসাবাদ করা; জব্দ তালিকা তৈরি করা; case ডায়েরি তৈরি করা; অতপর একটি পুর্নাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট ফৌ.কা- ১৭৩ ধারা অনুযায়ী আদালতে দাখিল করেন।
তদন্ত রিপোর্টঃ
এক কথায়, কোন অভিযোগ আসার পর পুলিশ তদন্ত শেষ করে ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ধারা ১৭৩ অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর যে রিপোর্ট পেশ করেন, তাকে পুলিশ রিপোর্ট বলে। এই রিপোর্ট সাধারণত দুই প্রকার, যথাঃ
১। চার্জশিট,
২। ফাইনাল রিপোর্ট।
তদন্তের সময় পুলিশ সাধারণত বাদীর আনিত অভিযোগগুলো সত্য মিথ্যা যাচাই করে থাকেন। ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট যত জন রয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে থাকেন, বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়ে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে আসামীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা সহ ইত্যাদি নানাবিধ উপায়ে তদন্ত করে থাকেন।
চার্জশীট কাকে বলে?
তদন্ত যখন শেষ হয়, তখন কোন মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ যদি বাদীর আনিত অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায়, সেক্ষেত্রে যে রিপোর্টটি প্রদান করেন, তাকে বলা হয় চার্জশিট। সেক্ষেত্রে এফ.আই.আর এ কারো নাম উল্লেখ থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে যদি খুজে পান সে মামলার ঘটনার সহিত জড়িত ছিলনা, তাহলে তার নাম বাদ কর্তন দিতে পারেন। আবার তদন্ত করে যদি খুজে পান এমন কোন ব্যাক্তি যার নাম এফ.আই.এ ছিলনা কিন্ত তিনি মামলা ঘটনার সহিত জড়িত তাহলে তাকেও আসামী করে চার্জশীটে নাম উল্লেখ করে দিতে পারেন।
ফাইনাল রিপোর্ট কাকে বলে?
যদি কোন মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ দেখতে পায় যে, বাদীর আনিত অভিযোগগুলো সত্য নয়, সেক্ষেত্রে যে রিপোর্ট প্রদান করে, তাকে বলে ফাইনাল রিপোর্ট। কোন মামলায় যদি তদন্ত শেষে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সেক্ষেত্রে আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাদী মামলা করার পর যদি তদন্ত রিপোর্টে আসামীর বিরুদ্ধে কোনো সত্যতা না পাওয়া যায় তথা পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সেক্ষেত্রে বাদীপক্ষ চাইলে উক্ত ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দাখিল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আদালত চাইলে বাদীর জবানবন্দী গ্রহন করে অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার মামলার প্রসঙ্গ:
আপনারা জানেন মৌলভীবাজার সহ দেশের বিভিন্ন থানায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট নেক্কারজনক ঘটনায় মামলা বা এজহার ও এফআইআর (FIR) দায়ের করা হয়েছে। উক্ত মামলা দায়েরের পরে একটি বিষয় জোড়ালোভাবে আলোচিত হচ্ছে, সেটি হলো অনেক নিরপরাধ মানুষের নাম এফ.আই.আর এ চলে আসছে যারা কিনা ঘটনার সহিত জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি যারা মামলার ঘটনার সহিত জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করছেন তারা মামলার বাদীর সহিত যোগাযোগ করায় বাদী থানায় তাদের জন্য একটি আলাদা দরখাস্থ দিয়ে বলেছেন যে, আসামী উক্ত মামলার সাথে সম্পৃক্ত নয় ভুলবশত তার নাম এফ.আই.আর এ চলে আসছে বা সংযোক্ত হয়েছে তাই তাদেরকে বা তাকে যেন মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। কিন্ত উক্ত দরখাস্থ প্রদান করার পরেও অনেক আসামীকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতে চালান দিচ্ছেন। কথা হলো দরখাস্থ দেওয়ার পরেও কি পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে কিনা? কথা হলো পুলিশ একটি মামলা পূর্নাঙ্গ তদন্ত করা ছাড়া বাদীর দরখাস্থের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করার সুযোগ কমই তাকে, তবে এটি মামলার প্রকৃতি বুঝে পুলিশের অনেকটা ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, কারন প্রতিটি মামলার বিষয়বস্তু ভিন্ন থাকে। পুলিশের দায়িত্ব হলো অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করা। বাদী বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হতে পারেন। পুলিশ তদন্তের পুর্বে বাদীর কথা শুনতে আইনত বাধ্য নয়।
বাদী আদালতে গিয়ে আসামীর পক্ষে জবানবন্দী প্রদান করিলে জামিন হবে কিনা?
দেখুন পুর্বেই আলোচনা করেছি এফ.আই.এর মামলার পরবর্তী ধাপ নির্ভর করে মামলার তদন্তের উপর। মামলা দায়েরের পরে বাদীর মামলার দায়িত্ব চলে যায় তদন্ত অফিসারের উপর। বাদী আদালতে গিয়ে আসামীর পক্ষে সাফাই দিলেও যেহেতু পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেনাই, সেহেতু বাদীর কথায় আদালত তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া আসামীকে জামিন দিয়ে দিবেন এমনটা চিন্তা করার সুযোগ নেই, কারন তদন্ত রিপোর্ট না আসলে আদালত বুঝবেন কিভাবে যে এই ব্যাক্তি প্রকৃত পক্ষে দুষি নন, কারন বাদীতো আসামীর মাধ্যমে প্রভাবিত হইতেও পারেন। বুঝতে হবে আদালত ও আইন একটি নিয়মের ভিতরে পরিচালিত হয়ে থাকে যাহা কিনা পুস্তিগত করা থাকে। আমরাতো প্রায় সময় শুনেই থাকি আকাশের যত তারা আইনে আছে তত ধারা। তবে অনেক ক্ষেত্রে মামলার প্রকৃতি বা অপরাধের ধরন বুঝে বাদীর জিম্মায় আদালত আসামীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন, যাহা কিনা সম্পুর্ণ আদালতের বিচারিক এখতিয়ার বা Jurisdiction এখানে কারোই হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।
বর্তমানে করনীয় কি? যেহেতু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মামলাগুলো নিয়ে একটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু আমি মনে করি এই মুহুর্তে মামলার বাদীর দায়িত্ব হলো আসামীদের কথায় আলাদা আলাদাভাবে আসামীদের জন্য দরখাস্থ না দিয়ে বরং থানায় ওসি মহোদয়ের সহিত যোগাযোগ করে অতি দ্রুত তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন যথা চার্জশীট/ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করার ব্যবস্থা গ্রহন করা। অর্থাত মামলার ঘটনার সহিত যারা জড়িত নন তাদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশীট আদালতে দাখিল করানো এবং যদি কোন বাদী মনে করেন মামলার সকল আসামীদের নাম কর্তন করে বা বাদ দিয়ে দিবেন, সেক্ষেত্রে ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করানো। তবে বাস্তবতা হলো একটি মামলা তদন্ত করতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন হয়, এই মামলাগুলো তদন্ত করতে একটু বেশি সময় লাগারই কথা এই ক্ষেত্রে দ্রুত চার্জশীট কিংবা ফাইনাল রিপোর্ট দাখিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার যতেষ্ট পরিমানের আন্তরিকতার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
পরিশেষে শত বাধা ডিঙ্গিয়ে সকল আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নিরীহ মানুষদের হয়রানী লাগবের স্বার্থে এই মামলাগুলো তদন্ত করে অতি দ্রুত চার্জশীট অথবা ফাইনাল রিপোর্ট মাননীয় আদালতে দাখিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার এসপি মহোদয়গন ও থানার ওসি মহোদয়গনকে বিনীতভাবে আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করি আপনাদের মহানোভবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।
যারা আসামী হয়েছেন আর নিরীহ বা নিরপরাধ দাবি করছেন তাদের প্রতি আহ্বান মামলার বাদীর উপর অযাচিত প্রভাব না কাঠিয়ে সময়ের বাস্তবতায় আপনাদের একটু ধৈর্য্য রাখতে হবে সমাধান অবশ্যই আসবে। বাদীর প্রতি আহ্বান আপনারা ভালো করে যাচাই বাচাই ও তদন্ত করে নিরপরাধ আসামীদের নাম চার্জশীট বা ফাইনাল রিপোর্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রচেষ্টা করবেন বলে আসা রাখি। ধন্যবাদ সবাইকে।
লেখক : নিয়ামুল হক
এডভোকেট, জজ কোর্ট মৌলভীবাজার ও ঢাকা।
সম্পাদক: আইন নথি
আপনার মতামত লিখুন :