আল্লাহ্পাক মহাঘটনার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। আবার আরেক মহাঘটনার মধ্য দিয়ে এ পৃথিবী ধ্বংস করবেন। যে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য মানুষ সীমাহীন সম্পদ গড়তে চায়। একে অন্যের ওপর দখলদারিত্ব ও কতৃত্ব খাটাতে চায় সেই পৃথিবীর ধ্বংসের ঘটনাকে আল্লাহ তাআলা নাম দিয়েছেন কিয়ামত। সেদিন আকাশ ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে, পাহাড়সমূহ তুলোর মতো উড়ে যাবে, সাগর ও মাটি সমান হয়ে যাবে আর কবর থেকে মানুষ বের হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে ছুটতে থাকবে আর বলবে, ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। অর্থাৎ হায় আমার কী হবে, হায় আমার কী হবে।
কিয়ামত এক মহাঘটনা হলেও এর আগে কিছু ছোট-ছোট ঘটনা ঘটবে যা আল্লাহর রসুল বলে গিয়েছেন। আজ আমারা জানার চেষ্টা করব, কিয়ামতের যেসব আলামত এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এ সম্পর্কে।
কিয়ামত শব্দটি আরবি। এর অর্থ উঠে দাঁড়ানো। এটি আরবি কিয়াম শব্দ থেকে এসেছে। নির্ধারিত সময় এলেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। মহান আল্লাহ কিয়ামত সংঘটনের দায়িত্বশীল ফেরেশতাকে শিঙায় ফুৎকার দিতে নির্দেশ দেবেন। এক আঘাতে সব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে। গ্রহ-নক্ষত্র খসে পড়বে। গোটা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কিয়ামত বলা হয় ওই দিনকে, যেদিন সৃষ্টিকুল ধ্বংস হবে, যেদিন লোকেরা তার রবের সামনে দাঁড়াবে। (রুহুল মাআনি: ৫/১২২)
কোরআনে কিয়ামতের আলোচনা
কোরআনে কিয়ামতের দিনটিকে অত্যন্ত ভয়াবহ ও ভীতিকর এক দিন হিসেবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেদিন সমস্ত সৃষ্টি ভীতিকর অবস্থায় পতিত হবে। কিয়ামতের সময় মানবজাতি সম্পূর্ণ অসহায় হবে, তাদের পক্ষে নিজেকে রক্ষা করা বা আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
يٰۤـاَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّكُمۡۚ اِنَّ زَلۡزَلَةَ السَّاعَةِ شَىۡءٌ عَظِيۡمٌ
يَوۡمَ تَرَوۡنَهَا تَذۡهَلُ كُلُّ مُرۡضِعَةٍ عَمَّاۤ اَرۡضَعَتۡ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمۡلٍ حَمۡلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكٰرٰى وَمَا هُمۡ بِسُكٰرٰى وَلٰـكِنَّ عَذَابَ اللّٰهِ شَدِيۡدٌৎ
মহান আল্লাহ বলেন- হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদানকারিণী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে। প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতালের মতো অথচ তারা মাতাল নয়। তবে আল্লাহর শাস্তি বড়ই কঠিন। (সুরা হজ ১-২)
আরেক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সবকিছু ধ্বংস হবে। বিধান তারই এবং তোমরা তারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে (সুরা কাসাস ৮৮) মহান আল্লাহ আরও বলেন, কাফেররা বলে আমাদের ওপর কিয়ামত আসবে না। বলুন কেন আসবে না? আমার পালনকর্তার শপথ, অবশ্যই আসবে। (সুরা সাবা ৩)
কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে?
কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে, তা সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহর জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। কোরআনুল কারিমে বিভিন্ন আয়াতে কিয়ামতের সময় সম্পর্কে জানতে চাওয়ার জবাবে মহান আল্লাহ বলেন, আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? বলে দিন এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। তিনিই তা অনাবৃত করে দেখাবেন নির্ধারিত সময়ে। আসমান ও জমিনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয়। যখন তা তোমাদের ওপর আসবে অজান্তেই এসে যাবে। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ বিশেষ করে আল্লাহর কাছেই রয়েছে। কিন্তু তা অধিকাংশ লোকই উপলব্ধি করে না। (সুরা আরাফ ১৮৭)
অনেকে জিজ্ঞেস করেন, কেয়ামত সংঘটিত হবে, কিন্তু কখন সংঘটিত হবে এর তারিখ বলা হয়নি কেন? মহান আল্লাহ কোরআনে এর উত্তর দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, কেয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকেই তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করে। (সুরা তহা ১৫)
কেয়ামতের যেসব আলামত এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে:
কিয়ামতের আলামত তিন প্রকার। ১. আলামতে বায়িদা- যা প্রকাশিত হয়ে গেছে। ২. আলামতে মুতাওয়াসসিতা- যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু শেষ হয়নি ধীরে ধীরে আরও প্রকাশিত হবে। ৩. আলামতে কাবিরা- যা বড় আলামত। একের পর এক প্রকাশিত হয়ে দ্রুত কিয়ামত হয়ে যাবে।
হাদিসের আলোকে আলামাতে বায়িদা বা যে আলামতগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ১৪টি। ১. নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন। (বুখারি ৪৯৩৬) ২. নবীজির মৃত্যু। ৩. বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের হাতে বিজয়। ৪. হজরত আউফ বিন মালেক (রা.)-এর অসুস্থ হয়ে শাহাদতবরণ। (ইবনে মাজাহ ৪০৪২) ৫. ওমর (রা.)-এর শাহাদত। (বুখারি ৫২৫) ৬. উসমান (রা.)-এর শাহাদত। (আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৭/১৯২)
৭. জঙ্গে জামাল, জঙ্গে সিফফীন, হাররাহ-এর ঘটনা। হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদত। (মুসতাদরাক হাকেম ৫৫৭৩, ৪৬১০)। ৮. তাতারি ফিতনা। (বুখারি ২৯২৮, ২৯২৭; শরহে নববি ১৮/৩৭) ৯. হেজাজ থেকে আগুন বের হওয়া। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না হিজাজের জমিন থেকে এমন আগুন বের হবে, যা ইরাকের বসরা শহরের উটগুলোর গর্দান আলোকিত করে দেবে। (বুখারি ৭১১৮)
এ ঘটনা হয়েছে ৬৫৪ হিজরিতে। এক মাস পর্যন্ত স্থির ছিল। আগুনটির দৈর্ঘ্য ১২ মাইল ও প্রশস্ততা ছিল ৪ মাইল। যে পাহাড় পর্যন্ত তা পৌঁছত তা মোমের মতো গলিয়ে দিত। স্ফুলিঙ্গ থেকে বিজলির মতো ও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো গর্জন শোনা যেত। মদিনার কাছে এসে তা থেমে যায়। আগুনের আলোয় রাতও দিনের মতো আলোকিত হয়েছিল।
১০. খারেজিদের উদ্ভব। (বুখারি ৬৯৩০) ১১. রাফেজিদের উদ্ভব। ১২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার পরে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইরাকে ফিতনা সৃষ্টি হবে। নবীজির এ ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যে পরিণত হয়েছে।
১৩. অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তীব্র ঠান্ডা ও দাবদাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যাপক হারে দেখা দেবে; এতে করে মাঠঘাট ফসলহীন হয়ে পড়বে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের উৎপাদন কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (FAO) তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ফসলের উৎপাদন প্রায় ২০-৩০% পর্যন্ত কমে গেছে। দিন দিন এটা কমতেই থাকবে।
১৪. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষের মধ্য থেকে যখন আমানতদারিতা উঠে যাবে, তখন তোমরা কিয়ামতের অপেক্ষায় থাকো। বর্তমানে ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, দুর্নীতি ও চুরি-ডাকাতি এত পরিমাণ বেড়ে গেছে যে, পৃথিবীতে আমানতদারিতা নেই বললেই চলে।
যেসব আলামত প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু শেষ হয়নি :
১. হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি তোমাদের সামনে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করছি, যা আমার পর তোমাদের নিকট আর কেউ বর্ণনা করবে না। আমি আল্লাহর রসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের কিছু আলামত হলো, জ্ঞান কমে যাবে, অজ্ঞতার প্রসার ঘটবে, ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে, নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে; এমনকি প্রতি ৫০ জন নারীর জন্য মাত্র একজন পুরুষ হবে পরিচালক। (বুখারি ৮১; মুসলিম: ২৬৭১)
এ বিষয়ে অন্য হাদিসে আবু মুসা আশআরি (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, মানুষের ওপর অবশ্যই এমন এক সময় আসবে, যখন লোকেরা সদকার স্বর্ণ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে; কিন্তু একজন গ্রহীতাও পাবে না। পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া ও নারীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ৪০ জন নারী একজন পুরুষের অধীনে থাকবে। তারা সে পুরুষের আশ্রয় গ্রহণ করবে। (বুখারি: ১৪১৪; মুসলিম: ১০১২)
২. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (স.) বলেন, কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যে পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন মিথ্যাচারী দাজ্জালের আবির্ভাব না হবে। এরা সবাই নিজেকে আল্লাহর রসুল বলে দাবি করবে। (বুখারি ৩৬০৯)
এ হাদিস অনুযায়ী, কিয়ামতের আগে ৩০ জন মিথ্যা নবুয়তের দাবি করবে। হাদিসের প্রেক্ষাপট থেকে অনুমেয়, এই ৩০ জনের ফিতনা হবে অনেক বিস্তৃত। যেমনটা মুসায়লামাতুল কাজজাব থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বহু মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার পৃথিবীতে নিজেদের কে নবী দাবি করে এসেছেন।
এভাবে ক্রমে আমরা কিয়ামতের ভয়াবহ সে দিনের খুব কাছাকাছি চলে আসছি। এ মহাপ্রলয়ংকারী দিনের অপেক্ষা করছে পৃথিবী। প্রতিনিয়ত মানুষকে সতর্ক করছে, যেনো মানুষ আল্লাহর বিধান মতো চলে, আল্লাহর হুকুম মতো পৃথিবীতে নিজেদেরকে পরিচালিত করে।
সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, প্রতারণা, ব্যভিচার, সত্যিকার আমানতদারিতার অভাব আজকের সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যা কিয়ামতের আলামতগুলোর প্রকাশেরই ইঙ্গিত দেয়। এ সব ঘটনা আমাদেরকে সতর্ক করে দেয় যে, মহাপ্রলয়ের দিন অতি নিকটে। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করা, যেন আল্লাহর নিকট পুণ্যবান হিসেবে হাশরের ময়দানে আমরা দাঁড়াতে পারি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন :