বুধবার (২০ নভেম্বর) বিশ্ব পাইলস দিবস ২০২৪। পাইলস রোগটির সাথে আমরা হাজার বছর ধরে পরিচিতি। এহা একপ্রকার ধাতুগত পীড়া। মলদ্বারের ভিতরে বা বাহিরের চার পাশের শিরা গুলো ফুলে মটরদানা কিংবা অঙ্গুরের মত কিংবা ছাগলের বাটের মত ছোট ছোট গলি বা টিউমার হলে তাকে অর্শ বা হেমোরয়েড বলে।
বয়স- ৩০-৬০ বৎসর বয়সের ভেতর এই রোগের প্রকোপ সব চেয়ে বেশী। ২০ বৎসর বয়সের নিচে পাইলস খুব একটা দেখা যায় না। পাইলস সনাক্ত করা খুব সহজ কাজ নয়। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কেবল যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে পাইলস সনাক্ত করতে পারেন।
কখনো কখনো টয়লেটে বসিয়ে কোথ দিতে হয়ে। আমাদের কাছে বিভিন্ন রোগী আসিয়া বলে আমার পাইলস। তখন রোগী লক্ষণ দেখি বুঝি পাই এনাল ফিশার, পলিপ অথবা ফিস্টুলা অর্থাৎ মলদ্বারের যে কোন রোগকে সবাই পাইলস হিসেবে জানেন। কিন্তু এইখানে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বৎসর বয়সের উর্দ্ধে জনসংখ্যার ৫০% বা কোন না কোন সময় পাইলস এর সমস্যায় ভোগেন।আর পাইলসের সমস্যায় নারী-পুরুষ অনেকেই ভুগে থাকেন। এটা বেশ যন্ত্রণাদায়ক একটা রোগ। তবে অনেকেই অহেতুক লজ্জায় রোগটি গোপন রাখেন এবং জটিলতা বাড়ান। অথচ কিছু নিয়ম মেনে চললে এই রোগ ঠেকানো যায়।আবার সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করে ভালোও থাকা যায়।
মানুষের মলদ্বারের দৈর্ঘ্য ২-৩ ইঞ্চি। এর ওপরের অংশকে বলে রেকটাম। রেকটামের নিচের অংশ তথা মলদ্বারের আশপাশে কিছু রক্তনালি থাকে, যাকে বলে রেকটাল ভেইন।
এই রেকটাল ভেইনগুলো যদি কোনো কারণে ফুলে যায় বা প্রদাহ হয় তাহলে পায়খানার সময় রক্তপাত হতে পারে। এই অবস্থাকে পাইলস বা হেমোরয়েড বলে। এটা সাধারণত দুই ধরনের হয় :
> এক্সটারনাল হেমোরয়েড
এ ক্ষেত্রে মলদ্বারের বাইরের রক্তনালিগুলোতে প্রদাহ হয়। ফলে পায়খানা করার সময় ব্যথা হয়, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হয়, মলদ্বারের আশপাশে চুলকানি হয়, ফুলেও যায়।
> ইন্টারনাল হেমোরয়েড
এ ক্ষেত্রে মলদ্বারের অভ্যন্তরীণ রক্তনালিগুলোতে প্রদাহ হয়ে ফুলে যায়। পায়খানার সঙ্গে স্বাভাবিক রক্ত যায়। অনেকের পায়খানা নরমাল হলেও টয়লেট পেপারে রক্ত দেখা যায়। এ ছাড়া পায়খানার সময় ব্যথা হয়, মলদ্বার দিয়ে মাংস পিণ্ডের মতো বেরিয়ে আসে, মলদ্বারে চুলকানি থাকে ইত্যাদি। রোগের জটিলতা বিবেচনায় ইন্টারনাল হেমোরয়েডের আবার চারটি স্তর রয়েছে।
> কারণ
* কোষ্ঠকাঠিন্য বা অনিয়মিত পায়খানা
* তীব্র ডায়রিয়া হলে
* গর্ভাবস্থা থাকলে
* ওবেসিটি তথা অতিরিক্ত শারীরিক ওজন
* দীর্ঘদিনের কাশি ইত্যাদি।
> উপসর্গ
* পায়খানার সময় রক্ত যাওয়া
* পায়ুপথের আশপাশে চুলকানি
* পায়খানার সময় ব্যথা
* মলদ্বার দিয়ে মাংসপিণ্ড বেরিয়ে আসা
* অনিয়মিত মলত্যাগ ইত্যাদি।
> পরীক্ষা
অনেক সময় রোগীর সমস্যা জেনেই পাইলস রোগটি নির্ণয় করা যায়। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন :- * ডিজিটাল রেকটাল এক্সামিনেশন * প্রক্টোস্কপি * কোলোনোস্কোপি
* সিগময়ডোস্কোপি ইত্যাদি।
> প্রতিরোধে করণীয়
গবেষণায় দেখা গেছে, মোটামুটি ৭০ শতাংশ পাইলসের জন্য দায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য। তাই কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বেঁচে থাকলে পাইলস থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। পাইলস প্রতিরোধে আরো যা করা উচিত তা হলো :
* নিয়মিত আঁশজাতীয় খাবার এবং শাক-সবজি বেশি খাওয়া* দৈনিক ২-৩ লিটার পানি পান করা * লাল মাংস কম খাওয়া * দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা * তেলে ভাজা কিংবা চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া ইত্যাদি।
> পরামর্শ
* প্রতিদিন ৪ চামচ ইসুপগুলের ভুসি দিয়ে দৈনিক ২ বেলা শরবত খান (দুই মাস)
* প্রতিদিন ২-৩টা আপেল খান এক মাস
* প্রত্যহ ২-৩ লিটার পানি পান করুন
* তেলে ভাজা খাবার ও লাল মাংস পরিহার করুন
* যেসব খাবার খেলে শক্ত পায়খানা হয় তা পরিহার করুন
* কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা ডায়রিয়া থাকলে তার সঠিক চিকিৎসা নিন
* পাইলসের সমস্যা বেশি মনে হলে বিলম্ব না করে একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
> হোমিও প্রতিবিধানঃ রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। আবার অনেক চিকিৎসক বের হইছে নিজেদেরকে অর্শ ভগন্দেরের চিকিৎসক বলে থাকে। কিন্তু ঐ সব ডাক্তার বাবুরা রোগীদেরকে ইনজেকশানের মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আবার মলম বা ক্রিম লাগাইতে রোগীদেরকে বলে। যেটা সাময়িক নিরাময়। কিন্তু পরে জঠিল আকার ধারন করে।
এইরকম অনেক চিকিৎসক সারাদেশে অনেক জায়গায় এইসব রোগীর অপচিকিৎসা দিয়ে থাকে। এইজন্য যেসব ডাক্তার নিজেদেরকে হানেমানের উত্তশ্বরী বলে থাকে তারা যেন রোগীর সঠিক লক্ষন নির্বাচন করতে পারলে তাহালে হোমিওতে অর্শরোগীর চিকিৎসা আল্লাহর রহমতে দেওয়া সম্ভব।
প্রাথমিক ভাবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকগন যেসব মেডিসিন নির্বাচন করে থাকে যেমন: এলুমিনা, এলো, আর্সেনিক এল, এন্টিম ক্রোড, এমন কার্ব, নার্কস ভোম, সালফার, ইস্কিউর্লাস হিপ, কলিন সোনিয়া, এসিডি নাইট্রেকাম ইত্যাদি সহ আরো অনেক ঔষুধ লক্ষনের উপর আসতে পারে । এইসব ঔষুধ গুলা বিশেষজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক ছাড়া নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরোও জঠিল আকারে পৌছতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজে অসংখ্য রোগী আছেন, যারা মলদ্বারে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে থাকেন। অনেক সময় লজ্জাবশত বলেন না কিংবা অপচিকিৎসার শিকার হন, এমনকি মরণব্যাধি-ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কখনও কখনও এমন পর্যায়ে উপস্থিত হন যে তখন আর অপারেশনের বিকল্প কিছু থাকে না। কিন্তু সঠিক সময়ে মলদ্বারের চিকিৎসায় পারদর্শী অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলে ৮০% ক্ষেত্রে বিনা অপারেশনে এর চিকিৎসা সম্ভব। আর মলদ্বারে যেকোনো রোগই হোক না কেন, সাধারণ মানুষ মনে করে-পাইলস/অর্শ/গেজ। তবে মলদ্বারের বিভিন্ন ধরনের রোগ হয় যেমন, এনাল ফিসার, পাইলস, রেকটাল পলিপ, রেকটাল ক্যান্সার, আই বি এস, পাইলোনিডাল-সাইনাস, এনাল আবসেস, রেকটাল প্রলাপস, এনাল ওয়াট, প্রকটালজিয়া-ফোগাস ইত্যাদি।তাই সুষ্ঠু এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করলে পাইলস রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বর্তমানে সময়ে অশ্ব বা পাইলস রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এজন্য সবার মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ সচেতনতাই পারে আমাদের এই বিভীষিকা থেকে দূরে রাখতে পারে।
লেখক: চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :