আমার আব্বা মাওলানা মোঃ মোজাহিরুল হক (রাহিমাহুল্লাহ) এর আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। প্রকৃতির আমোঘ নিয়মেই আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন আব্বা আমাদের ছেড়ে সাড়া দিয়েছেন আল্লাহর ডাকে। আব্বা চলে যাবার আজ দুই বছর হলো। এই দুই বছরে প্রতি দিনই বাবার অপরিসীম শূন্যতা অনূভব করেছি। বাবার ছায়া কি যে বিশাল সেটি বোধহয় কেবল যারা হারায় তারাই বুঝে।
কারও বাবা-মা চিরজীবন বেঁচে থাকেন না। মানুষের জন্মই হয় একদিন মৃত্যুর স্বাদ লাভ করার জন্য। সবাই মরণশীল। তবুও এত কষ্ট হয় কেন চলে যাওয়ায়?
বুকভরা বিষণ্নতা আজ আমাকে অশ্রুসিক্ত করছে। ২০২২ সালের আজকের দিনে আমার আব্বা সিলেটেরএকটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে প্রতিটি ৬ ডিসেম্বর আমার মন বেদনার ঘন কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়। আব্বার কথা মনে পড়লেই চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। এলোমেলো ভিড় করে অজস্র স্মৃতি।
আব্বার ত্যাগ-ম্মৃতি হরদম মনের গ্যালারিতে ভাসলেও আজকের এদিনে অশ্রু ঝরে নিতান্ত সংগোপনে। কারণ, পরিবারের অন্য কেউ তা দেখলে সে–ও অশ্রু ঝরাবে। হয়তো অন্যরাও আড়ালে একই কাজ করে!
প্রয়াত আব্বার কথা ও স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। এতটা ভালোবাসি আমার হারানো আব্বাকে, অথচ কখনো তাঁকে বলতে পারিনি। এমনকি বাবার সঙ্গে এক ফ্রেমে আমার নিজের একটা ছবি পর্যন্তও তোলা নেই! অথচ তাঁর স্মৃতি আমার হৃদয়পটে আজও ভাস্বর!
বাবা-ভালোবাসা ও ভালো লাগার শব্দ। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের শব্দ। স্নেহের শীতল ছায়াতলের বটবৃক্ষের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার মতো শব্দ `বাবা`।
বাবাকে আমি এবং আমাদের ভাই-বোনেরা ‘আব্বা’ ডাকতাম, আমার কাছে মনে হতো এই সম্বোধনটাই বেশি কোমল এবং বেশি কাছের। প্রতিটি সন্তানের বুক জুড়ে থাকে বাবার প্রতি চির অম্লান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জগতের সকল কিছুর তুলনার ঊর্ধে।
কোথায় যেন কী নেই। আকাশের দিকে তাকালে আকাশে সুুরুজ নেই। রাতের সিতারা নেই। চাঁদ নেই। জোছনা নেই। দিকে দিকে খাঁ খাঁ শূন্যতা ভর করেছে। আব্বার সাহচার্য-সহযোগিতার কাঙাল হয়ে উঠছি দিন দিন।
বাবা তো বাবাই। পৃথিবীর কিছু দিয়ে কি তার তুলনা চলে? সন্তানের বড় হওয়ায় যাবতীয় আয়োজন। মানুষ হওয়ার যাবতীয় প্রোগ্রাম সব তো বাবাই করেন। বাবা আর ফিরবে না। আসলে যার বাবা আছে সে বোঝে না বাবা কী। যার নেই সেই বোঝে!
আব্বার মৃত্যুর পর থেকে যখন কোনো বিপদে দিশাহারা হয়ে পড়ি।অভিভাবকহীনতার কষ্টে ভুগি। কারও পরামর্শ চাইলে শুনতে হয়- দেখ, তুমি অনেক দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছ, আমাদের চেয়ে ভালো বুঝ-যা ভালো মনে করো, তাই করো।
বাবা থাকতে মনে হতো না আমি বড় হয়েছি, মনে হতো এখনো ছোট আছি। এখন মনে হয় বয়স হয়েছে, নিজেরই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাবা হারানোর ব্যথা বা বাবাহীন জীবনের কষ্ট ভয়ানক। যে বাবা হারায়নি সে এই ব্যথা বুঝবে না।
আমার আব্বা প্রচারবিমুখ মুুখলিছ আলেম ছিলেন। পাকিস্তানের করাচি থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স ডিগ্রি) শেষ করে বিভিন্ন মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সিলেটের বরেণ্য বুজুর্গ আল্লামা নুর উদ্দিন গহরপুরী রহ. নির্দেশে সাইটুলা ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আমৃত্যু তিনি শিক্ষকতা করেছেন। দেশ-বিদেশে বহু শিক্ষার্থী গড়েছেন।
আমার বাবা একজন আলেম হওয়ার কারণে তিনি দ্বীন পালনে এবং পরিবারকে দ্বীন পালনে এবং নীতি আদর্শে ছিলেন অটল। আদর্শবান বাবা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে একটুও শিথিলতা প্রদর্শন করেননি। আমাদের পরিবারের সবাইকে দ্বীনি শিক্ষা-ধর্মকর্ম পালনে সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেন।
মানুষ হিসেবে যেসব মৌলিক গুণ থাকা উচিত, তাঁর সব কিছুই আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। তিনি সদা হাস্যজ্বল মানুষের বিপদে-আপদে তাদের আন্তরিকভাবে পাশে থাকতেন।
তিনি সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন, কারো কোনো ক্ষতি করেননি। কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি কোরো না। ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি।
আব্বা আলেম-উলামা, তার শাগরেদ ও আত্মীয়স্বজনসহ বাড়িতে কেউ এলে কখনোই তাঁকে কিছু না খাইয়ে বাবা বিদায় দিতেন না। আপ্যায়ন করতে তিনি ভালোবাসতেন।
তাঁর শিক্ষকতার আদর্শই তার সমগ্র জীবনাচরণের অঙ্কুর ও শেকড়কে ধারণ করেছিল। এদিকে তার সকল মানবিক গুণাবলি, কর্তব্য-পরায়ণতা, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, সাহসিকতা ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর সমুদয় সত্যনিষ্ঠায় যর্থাথই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় I
বাবা আমাদের জন্য তাঁর নীতি-আদর্শ রেখে গেছেন। আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।
আব্বার মৃত্যুর পর অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাসায় তাঁরা এসেছেন। দেশের নানা প্রান্ত ও দেশের বাইরে থেকে ফোন করেছেন। বাবার প্রতি তাঁদের যে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি দেখেছি, তা অতুলনীয় ও হৃদয়স্পর্শী। ভালোবাসার সম্ভবত একটি তরঙ্গ আছে।
আব্বা যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তারাও তেমনি ভালোবাসতেন আব্বাকে। ভালোবাসার সেই অদৃশ্য তরঙ্গ সবাইকে স্পর্শ করতো।
আব্বার জানাজায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিপুল মানুষ এসেছিলেন। সবাই আব্বার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন, একজন ভালো মানুষ হিসেবে তাঁর হয়ে মাফ চেয়েছেন।
আব্বার মৃত্যু পরবর্তী মানুষদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটা ভুলার মতো নয়। এগুলো আদতে অর্জন। আব্বা নেই আজ দুই বছর পূর্ণ হয়েছে, অথচ সেই একই পরিচিতি, একই ভালোবাসা আমরা পেয়ে যাচ্ছি। এগুলো দেখে মনে হয় আব্বা দৈহিকভাবে হয়ত নেই কিন্তু তাঁর পরিচিতি এখনও রয়ে গেছে। এগুলো দেখে একদিকে গর্ব হয়, আবার অন্যদিকে নিজেকে পিতৃহীন ভেবে বুকটা হাহাকার করে ওঠে! এই হাহাকারের যন্ত্রণা যে কতটা ভারী সেটা ঠিক ঠিক টের পাই; আমি নিশ্চিত জগতের অধিকাংশ পিতৃহীনেরাই টের পায়।
আমার আব্বা (রহ.) মাওলানা মোজাহিরুল হক ১৯৫৩ সালের ৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের করাচি মাদরাসা থেকে ১৯৭০ সালে দাওরায়ে হাদিস কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। পাকিস্তানের হাফিজুল হাদিস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তি (রহ.) এর কাছে শিক্ষা এবং বাইয়াতগ্রহণ করেন।
ইলমে দ্বীনের সর্বোচ্চ ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে এসে প্রথমে হবিগঞ্জের একটি মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর সত্তর দশকে শ্রীমঙ্গলের জুলেখা নগর চা বাগান মসজিদে ইমামতি পদে যোগদেন।
১৯৮৯ সালে শায়খে গহরপুরী রহ. এর নির্দেশে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের সাইটুলা গ্রামে ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা কনের তিনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুকালে আব্বা ৩ ছেলে ও ৬ মেয়েসহ নাতী-নাতনী, বহু ছাত্র ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৯।
ওগো আরশে আজিমের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, আপনার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের আব্বাকে মাফ করে দেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তারা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন। আমীন। `রাব্বিরহামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা`
লেখক : এহসান বিন মুজাহির, সাংবাদিক
কলামিস্ট ও প্রিন্সিপাল শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল
আপনার মতামত লিখুন :