সোমবার ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস ২০২৪। ‘বিজয়’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অজস্র ত্যাগ। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি মুক্তিযুদ্ধের সেই সকল বীর সন্তানদের প্রতি, যাঁরা তাঁদের জীবন ও রক্ত দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার আলোয় আলোকিত করেছিলেন! এটি আমাদের গৌরবের, বিজয়ের, আর আনন্দ-অশ্রু-মাখা এক মুক্তির দিন। আজ থেকে ঠিক ৫৩ বছর আগে, এই দিনে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ বিজয়ের পতাকায় আকাশ-বাতাসে উদ্ভাসিত হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীনতা, যা আজও আমাদের হৃদয়ে অমর সত্ত্বার মতো বাস করে। আজকের এই মহান দিবসে আমরা পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলাম।
> ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপট এবং নতুন প্রত্যাশা
আজ, ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা উদযাপন করছি। যদি আবার আমরা সেই পুরনো চেতনার আলোয় আলোকিত হতে চাই, তবে এই চেতনায় জড়িত থাকবে নতুন দিনের আহ্বান, নতুন সম্ভাবনা। আজ আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নতুন রূপ নিচ্ছে, আমরা চাই এই পরিবর্তন জাতির উন্নতি, ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে সাফল্য এনে দেবে। পরিবর্তিত এই সম্ভাবনাময় দিনে আবার আমাদেরকে বৈষম্যহীন এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।আর আমাদের যুব সমাজ, আমাদের তরুণ প্রজন্ম আজ আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে। তাঁদের মধ্যে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার শক্তি, ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। এই প্রজন্মের কাঁধে আমাদের দেশের উন্নয়নের ভার, আর তাদের হাত ধরে আমরা যেতে চাই এক নতুন, এক স্বপ্নময় দিগন্তে। কবির সেই বিখ্যাত পঙক্তির মতোই—“আমরা নবজাতক, নতুন দিনের আশায় বুক বেঁধেছি; আমাদের শপথ, আলো ছড়াবো দেশে দেশে।”
> বিজয় দিবসের চেতনা: নতুন দিনের প্রেরণা
বিজয় দিবসের চেতনা শুধু অতীতের নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের পাথেয়। যে আত্মত্যাগে আজকের এই দিন সম্ভব হয়েছে, সেই বীরদের আত্মার কাছে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত যে আমরা জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবো। দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রক্ষা, সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণ, এবং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার যেন আমরা পালন করি।
আজকের এই দিনে আমরা প্রতিজ্ঞা করতে পারি, আমাদের যে লক্ষ্য—দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সুশাসন এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা—সেই লক্ষ্যে আমরা একতাবদ্ধ থাকবো। প্রতিটি মানুষ যেন পায় নিজের মর্যাদা, নিজের পরিচয়, এবং নিজের স্বাধীনতা।
> নতুন দিনের সম্ভাবনা ও আশাবাদ
বিজয় দিবসের চেতনা আমাদেরকে শুধু অতীতের সংগ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয় না, বরং আমাদের সামনে একটি নতুন দিনের সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করে দেয়। আমরা যেন সব রকম ভেদাভেদ ভুলে, একসাথে কাজ করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন তাদের দক্ষতা, মেধা, এবং পরিশ্রম দিয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে পারে, সেই দায়িত্ব আমাদের।দেশের প্রযুক্তি, শিক্ষা, এবং শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রকে বিশ্বমানের দিকে এগিয়ে নেওয়া আমাদের লক্ষ্যের একটি অংশ হওয়া উচিত। আজকের প্রজন্মকে নিয়ে আমাদের যতটা আশা, তার দ্বিগুণ সম্ভাবনা রয়েছে তাদের মধ্যে। কবির সেই চরণ যেন মনে করিয়ে দেয়“পথিক, তব হৃদয় হতে গাহিয়া যাও স্বপ্নের গান, যেন দুঃখের কান্না ছাড়াই জয় করে সুখের গান।” প্রিয় পাঠকবর্গ বিজয় দিবসের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আসুন আমরা আরও একবার নতুন করে শপথ নিই, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে স্বপ্নের সেই উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য আমাদের একতাবদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমাদের দেশ যেন শান্তি, প্রগতি, এবং সুখের প্রতীক হয়ে ওঠে। আমাদের নবপ্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাই যে, তারা হবে এমন এক বাংলাদেশ নির্মাতা যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে।আর আজকের এই দিনে আমি আপনাদের সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন আমরা শপথ নিই—আমাদের মাতৃভূমিকে স্বচ্ছ, ন্যায়পরায়ণ এবং সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা একযোগে কাজ করবো। আমরা যেন সেই অনাগত দিনের প্রত্যাশায় এগিয়ে যাই, যেখানে বাংলাদেশ হবে সকল মানুষের গৌরবের কেন্দ্রবিন্দু।
> মূলত প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক তিন ধরনের অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা পায় :
১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। সামাজিক অধিকার: জীবন ধারণের অধিকার. ২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মতপ্রকাশের অধিকার, ৪ সভা-সমিতি করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার। রাজনৈতিক অধিকার: ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনার অধিকার, ৫. চাকরি লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার। অর্থনৈতিক অধিকার: কাজের অধিকার, ২ উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
পরিশেষ বলতে চাই,স্বাধীনতা প্রত্যেক জাতির জন্যই সবচেয়ে বড় অর্জন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মাধ্যমে। আর যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত হবে; অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন, ধর্মীয় ভেদাভেদ, বৈষম্যের অবসান ঘটবে। আমরা এমন এক ন্যায়ানুগ সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে সবার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে; সকল প্রকার কুসংস্কার ও অশিক্ষা দূর হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন, অনৈক্য, শ্রেণিবিশেষের অহমিকা ও ক্ষমতালিপ্সার কারণে আমাদের সে স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। তাই বিজয় দিবসের এই মহান দিনটিতে আসুন আমরা স্মরণ করি সেই সব অকুতোভয় বীরদের যাঁরা আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন। আমরা যেন তাঁদের ত্যাগকে সম্মান দিয়ে দেশকে আরও উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেই। আমাদের এই যাত্রা যেন অবিরত চলতে থাকে।সর্বোপরি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার অদ্যাবধি অনেকাংশেই অধরা রহিয়াছে। এবারের বিজয় দিবসে তাই আমাদের প্রত্যাশা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমের মাহাত্ম্যকে লালন করে প্রত্যেক নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। তবেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারব সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।মহান বিজয় দিবসে এ প্রত্যাশাই করছি।
লেখক, সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
আপনার মতামত লিখুন :