সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। এ প্রাকৃতিক পরিবেশের মূল উপাদান হলো জীব ও উদ্ভিদ । ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব প্রভৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে জীবসম্প্রদায় বা জীববৈচিত্র্য। মাটি, নদী, গভীর সমুদ্রসহ আমাদের চারিপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা প্রজাতির জীব। এ জীববৈচিত্র্যই পরিবেশের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। কেবল পরিবেশের নিয়ন্ত্রকই নয়, মানুষের জীবনযাত্রার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোও এরাই জোগান দিয়ে থাকে। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতির জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষ এই জীবসম্প্রদায়ের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় হলেও একথা সত্য, মানুষের বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপে এই জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বন উজাড় হচ্ছে, পানি দূষিত হচ্ছে এবং এদের বাসস্থান ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বিগত কয়েক দশকের একটি আলোচিত বিষয় হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, যা এই জীববৈচিত্র্য ধ্বংসেরই নামান্তর। আমাদের প্রয়োজন ৯০ ভাগ ক্যালরি; এসব আমরা পেয়ে থাকি ৮০ রকমের উদ্ভিদ থেকে। এছাড়া ফল, বাদাম জাতীয় শস্য, মাশরুম, মধু, মসলা জাতীয় শস্যসহ অন্যান্য অনেক খাবারই আমরা উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকি। বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ চিকিৎসার প্রাথমিক উৎস হিসেবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। বাজারে প্রচলিত ওষুধের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগের উৎসই হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী।
ক্যান্সার, ব্যথানাশক, রক্তচাপ, ম্যালেরিয়াসহ অনেক রোগের চিকিৎসায় ঔষধি উদ্ভিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে ৫০০-এরও বেশি উদ্ভিদ পাওয়া যায়, যার ঔষধি গুণাগুণ আছে। অনেক প্রজাতি প্রাকৃতিকভাবেই ঝোপঝাঁড় বা বনাঞ্চলে পাওয়া যেত; কিন্তু এখন পাওয়া যায় না। ঔষধি উদ্ভিদ ছাড়াও আমাদের ঘরবাড়ি তৈরি, আসবাবপত্র ও জ্বালানির জন্য বন বা উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যক্ষ অবদান ছাড়াও জীববৈচিত্র্য অনেক জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য আমাদের বিশ্রাম ছাড়াও শান্তি, আনন্দ, সৌন্দর্য ও চিন্তার খোরাক জোগায়। জীবজগতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যথাযথ ভূমিকা পালনে জীবজগতের প্রাচুর্যতা খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যেমন পরাগায়ণের জন্য অনেক সপুষ্পক উদ্ভিদে মৌমাছি, প্রজাপতি, পাখি ও বাদুড়ের উপস্থিতি ও প্রাচুর্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত। বনের উদ্ভিদরাজি আমাদের বাতাস ও পানি পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। পৃথিবীর উষ্ণতার জন্য প্রধান দায়ী গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছপালা কর্তৃক শোষণের মাধ্যমে আমাদের আবহাওয়া তথা তাপমাত্রাকে শীতল করতে সাহায্য করে। এছাড়া প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনাঞ্চলগুলোতে বহু প্রজাতির সমন্বয়ে জীবজগতের প্রাচুর্যতা বজায় রাখা যায়। এসব প্রাচুর্যময় জীবজগৎ আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের একমাত্র সুন্দরবনের ওপর প্রায় ১০ লক্ষাধিক লোকের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। তাছাড়া, বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকা নির্বাহে সরাসরি বনের বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপর নির্ভর করে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ এক সময় জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার ৭০০ সপুষ্পক উদ্ভিদ, ২৭৬ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির স্থানীয় পাখি ও ১১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী বিদ্যমান ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশ বিপর্যয়কারী উন্নয়ন কার্যক্রম, বন উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিক আহরণ, আবাসস্থল ধ্বংস, আগ্রাসী প্রজাতির আগমন ইত্যাদি আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য হ্রাসে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। কৃষিশস্য বৈচিত্র্যেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী ছিল। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে এক সময় প্রায় ১৫ হাজার রকমের ভ্যারাইটিজ জাতের ধান বিদ্যমান ছিল। বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মিটানোর জন্য উচ্চফলনশীল ধান (ইরি, হাইব্রিড ইত্যাদি) চাষ করতে গিয়ে সেসব ভিন্ন স্বাদ ও জাতের বৈচিত্র্যধর্মী ধানের জাতগুলো আমরা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। এসব উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করতে গিয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণে জলাভূমিতে মাছসহ বিভিন্ন ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটনও হারিয়ে ফেলেছি।
বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২৬৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩০০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ১৭৭ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ৭ প্রজাতির কাঁকড়া, ১৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৩ প্রজাতির কচ্ছপ ও ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। আমাদের বিশ্বাস সঠিকভাবে সার্ভে করা হলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে আশংকার বিষয় বিভিন্ন কারণ যেমন ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অত্যধিক সম্পদ আহরণের ফলে সুন্দরবনের ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হুমকির সম্মুখীন এবং বিলুপ্ত হওয়ার পথে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ কম হলেও বনের জীববৈচিত্র্য অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় প্রাচুর্যে ভরপুর। আনুমানিক ৪০০ বৃক্ষ প্রজাতির আবাসস্থল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের এসব বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে ৩-৪টি প্রজাতির বনায়নে রূপান্তরিত হচ্ছে। ১৮৭১ সালে সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের রামু পাহাড়-সীতাপাহাড় এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সাফাই কাটার পর সেগুন চারা লাগানোর মাধ্যমে বন ব্যবস্থাপনার সূত্রপাত হলেও বিগত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড়ের রেকর্ড উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। মূল্যবান কাঠ হিসেবে সেগুনের চাহিদা থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে দ্রুত বর্ধনশীল বৃক্ষ হিসেবে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, গামারসহ দ্রুত বর্ধনশীল স্বল্পমেয়াদি গাছের বনায়ন আমাদের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল দ্রুত গ্রাস করতে থাকে। ধীর বর্ধনশীলতার অজুহাতে অনেকটা অবিবেচক এর মতো দেশীয় মূল্যবান বৃক্ষ প্রজাতির বনায়নে কোনো সময়ই যথাযোগ্য অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়নি। এতে প্রতিবেশ ও পরিবেশের বরাবরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বন উজাড়, ভূমির বিকল্প ব্যবহার, বসতি স্থাপনসহ ভূমিদস্যু ও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মূল্যবান দেশীয় বৃক্ষ প্রজাতির বিলুপ্তি অনেকাংশেই ত্বরান্বিত হয়। হাজার বছরের সাকসেশন প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা বনাঞ্চল বিশেষ করে শাল ও পাহাড়ি বনাঞ্চলের উদ্ভিদরাজি যেমন বৈচিত্র্য ভরপুর ছিল, ঠিক তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ বন্য প্রাণীকূলের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবেও বিবেচিত হতো।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে , আমরা আমাদের সেই মূল্যবান জীববৈচিত্র্যের অধিকাংশই হারিয়ে ফেলেছি। সারা বিশ্বে জীববৈচিত্র্য হ্রাসের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালে ওই সনদে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালে অনুসমর্থন করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশ্ববাসীর সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেয়। তাই আজ আমরা বিশ্বের আরও ১৯৫টি দেশের সঙ্গে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। কিন্তু অদ্যাবদি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমাদের উদ্যোগ আশানুরূপ নয়। এরই মধ্যে বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের দেশে ১০৬ প্রজাতির গাছ, ৫৪ প্রজাতির মাছ, ৪১ প্রকার পাখি, ৪০ প্রকার সরীসৃপ ও বহু স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে বলে জানা যায়। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না হলে এ সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। ভবিষ্যৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফিত হলে উপকূলীয় এলাকায় জীববৈচিত্র্য বিশেষ করে কৃষিবৈচিত্র্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জীববৈচিত্র্য মানবজাতির উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ টিকে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিরাট জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জীবনযাত্রা উন্নয়নে জীববৈচিত্র্যের বিকল্প কিছু নেই। আমরা আমাদের প্রয়োজনেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করবো,এটাই হোক সকলের অঙ্গীকার ।’
হৃদয় দেবনাথ: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন :