চা শ্রমিক সন্তানদের নিয়ে ধারাবাহিক পাঁচ পর্বের প্রতিবেদন এর ৩য় পর্ব
নেশায় আসক্ত শিশু-কিশোরদের নিয়ে এখন আর পুলিশ প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। পুলিশের সামনেই তারা ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজের ওপরে বা নিচে নির্বিঘ্নে মাদক সেবন করে। এ নিয়ে কোথাও বাধার মুখে পড়ার খবর পাওয়া যায়নি। বরং ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে—কেউ তাদের থামাতে গেলে, টহল পুলিশ উল্টো শাসিয়ে সতর্কবার্তা দেয় এবং বিরক্ত না করার নির্দেশনা দেয়।
এসব শিশু যে কোনও সময়ে যে কাউকে হেনস্তা করে। আরও বেশি কিছু করতে পারে। এদের নিয়ে কাজ করছেন এমন এনজিও কর্মী ও গবেষকরা বলছেন, সারাদিনের আয়ের বড় অংশ সন্ধ্যার পর নেশায় ব্যয় করছে এসব শিশু-কিশোর। রাজধানী ঢাকার পুরানো পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, আনন্দবাজার, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পথশিশুদের হাতে দেখা যায় নেশা করার উপকরণ ড্যান্ডি। কেউ বলে ডাস্টবিনের ময়লা পরিষ্কারের কষ্ট দূর করতে এ নেশা করা হয়, কেউ বলছে থাকা খাওয়ার জায়গা নেই, ওরা সেই কষ্ট ভুলতে চায়, কেউ রাস্তায় দুবেলা খেতে না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে কথা বলে। তাদের সঙ্গে কথা বলে সরেজমিনে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সুনির্দিষ্ট পুনর্বাসন ব্যবস্থা করে দিতে না পারায় মাদক থেকে ফিরিয়ে আনলেও তারা আবারও সেই পথেই নামছে এবং মাদক সেবন শুরু করছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার কমলাপুর এলাকার ৬০ শতাংশ শিশু মাদকাসক্ত। এরমধ্যে পথশিশুদের ৫৩ শতাংশের বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। যাদের ৮৩ শতাংশই নিজেদের খাবার নিজেরাই সংগ্রহ করে। তবে পথ শিশু বলে কিছু নেই। পথে কোনও শিশু জন্মানোর কারণে সে পথ শিশু হয় না। সমাজ তাদেরকে পথ শিশু বানায়। দারিদ্র্য, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বাবা-মা মারা যাওয়া বা বাবা-মায়ের অসচেতনতা অথবা অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর ছোবল তাদেরকে এই পথে এনেছে। তবে শিশু অপরাধের শাস্তি কম এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে অপরাধ করানো সম্ভব হওয়ায় অপরাধীদের সহজ টার্গেট ছিন্নমূল বা পথশিশু। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তায় পেশাদার অপরাধীরা পথশিশুদের দিয়ে অপরাধীরা করিয়ে নিজেরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। আবার সহজলভ্য হওয়ায় এসব শিশুকে অনেক সময় বিদেশেও পাচার করা হয়। পরিবার বা রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার অভাবে সেইসব খবর অজানাই থেকে যায়।
সালাম (ছদ্ম নাম) বাবা-মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর সৎ মায়ের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে ঠাঁই নিয়েছে রেলস্টেশনে। ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলে টাকার লোভ দেখিয়ে দলে ভেড়ায় রহিম। চুরি ছিনতাইয়ের সঙ্গে মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে নিজেই মাদকাসক্ত। শুরু হয় ড্যান্ডি দিয়ে এরপর হেরোইন, নেশার ইনজেকশন ও ট্যাবলেট। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাইয়ের পাশাপাশি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকা চুরি করেছিল রহিম। রহিমের মত অনেক পথশিশু এখন অন্ধকার পথের যাত্রী!
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণা বলছে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোনও না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। মহানগরে প্রায় তিন শতাধিক মাদকের স্পট রয়েছে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক সহায়তায় পাড়া-মহল্লার মাস্তান সিন্ডিকেট এসব শিশুকে অপরাধে ব্যবহার করায় আসল অপরাধীরা সব সময় আড়ালেই থেকে যায়।
পথের এসব শিশুদের নিয়ে রাষ্ট্রও উদাসীন। সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, ‘রাতের ঢাকায় ভীষণ বিপদজ্জনক অবস্থায় রয়েছে পথশিশুরা। ঝড়, বর্ষা-বাদলেও রাত কাটে আবাসহীন। ঠিকমতো খাবার জোটে না তিনবেলা। এমন অনিশ্চয়তায় বেড়ে উঠছে লাখো পথশিশু। পথশিশুদের নিয়ে পরিষ্কার রোড ম্যাপ থাকলেও সমন্বয়ের অভাবে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ- বিআইডিএস`র হিসাবে রাজধানীর কমলাপুর, কারওয়ান বাজার, বাসস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালসহ পুরো রাজধানী জুড়ে পথশিশু রয়েছে সাড়ে চার লাখের বেশি। কমলাপুর স্টেশন এলাকায় থাকা কয়েকজন পথশিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতে ঘুমাতে গেলে পুলিশ তাদের মারে, দিনেও মারে। সমাজ-রাষ্ট্রের নীরবতা তাদের এই নিয়তি থেকে বাঁচার পথও দেখাচ্ছে না।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :