চা শ্রমিক সন্তানদের নিয়ে ধারাবাহিক পাঁচ পর্বের প্রতিবেদন এর ৪র্থ পর্ব
পড়ালেখা সুনিশ্চিত করাসহ শিশুদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করার লক্ষ্য সারাবিশ্বে যখন বাস্তবমুখী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে সেখানে শিশুশ্রম বৃদ্ধিসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় শিশুদের ঝরে পরা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশে চা বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে। গত বছর বৈশ্বিক মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) জরিপ অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলার চা বাগানগুলোতে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ চা শ্রমিক শিশু, মোলভীবাজারে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সিলেটে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
খাদ্য সংকট, বাসস্থানের অভাব ও উন্নত জীবনমান নিশ্চিত না হওয়ায় চা শ্রমিক শিশুরা পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাধ্য হয়ে চা বাগানে কাজে ভিড়তে হচ্ছে। যে বয়সে শিশুদের ব্যাগ কাঁধে হাসিখুশিতে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে তারা ভোরে ঘুম থেকে ওঠে খাঁচি কাঁধে চা বাগানে ভিড়তে হচ্ছে জীবিকার তাগিদে।
দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী চা বাগানে ন্যুনতম ২৫জন শিক্ষার্থী থাকলেই বাগান কর্তৃপক্ষকে একটা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অথচ দেশে ১৬৭টি চা বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৯টি (মতান্তর ১২-১৪টি)। মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৩টি, নেই কোনো কলেজ। সরকার সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে অথচ বিভিন্ন জরিপের তথ্যমতে, চা শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। সারাদেশে যেখানে ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে সেখানে চা শ্রমিক শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হার শতকরা ৪৯ শতাংশ। চা বাগানগুলোতে যে কয়টি বিদ্যালয়ে রয়েছে সেখানে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে মাত্র একজন শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিদ্যালয়ে অনুসরণ করা হয় না যথাযথ শিক্ষা কারিকুলাম। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম তদারকির কোনো ব্যবস্থাও নেই সরকার কিংবা বাগান মালিক পক্ষের। সরকারি বইগুলো শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় পেলেও দেয়া হয় না উপবৃত্তি, পোশাক বা খাতা। ব্যবস্থা নেই দুপুরের টিফিনেরও। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বাড়ছে চা শ্রমিক শিশুদের।
পড়াশোনায় দৈনিক বরাদ্দ দেড় টাকা: চা বাগান মালিক সমিতির পোষ্য কোটা হিসেবে চা শ্রমিক শিশুদের পড়ালেখার জন্য মাসিক জনপ্রতি বরাদ্দ মাত্র ৪৫ টাকা। যা দিনে গড়ে পরে মাত্র দেড় টাকা। মাসিক এই ৪৫ টাকা বরাদ্দে পড়ালেখা করতে পারা তো দুরূহ, কলম, বই-খাতা কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বাবা-মা’দের।
গত কয়েক বছর ধরে সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে চা শ্রমিকদের আগ্রহ বাড়লেও উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ এবং টাকার অভাবে পড়াতে পারছেন না বাবা-মা’য়েরা। তাদের দাবি, শিশুদের শিক্ষার জন্য বাগান মালিকদের পোষ্য কোটায় মাসিক বরাদ্দ দৈনিক দেড় টাকায় শিক্ষা উপকরণ কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। মায়ের সাথে শ্রীমঙ্গল এক চা বাগানে কাজ করছেন ১৩ বছর বয়সী প্রবণী। প্রবণীর মা জানান, “পড়ালেখার জন্য যে টাকা দেয়া হয় তা দিয়ে কলম, খাতা কিছু কিনে দিতে পারি না। এছাড়া স্কুলের ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি’র টাকা জোগাড় করতে পারি না। আমাদেরও তো ইচ্ছে করে সন্তানদের লেখাপাড়া করাইতে। কিন্তু টাকার অভাবে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে এখানে (চা বাগানে) নিয়ে আসতে হলো। সে থাকলে আমার রোজকার একটু ভালো হয়। সে ২৫-৩০ কেজি পাতা তুলে দিতে পারে।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, বাগানভেদে চা শ্রমিক শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের হার শতকরা ৩৫-৫৯ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে প্রায় ২১ শতাংশ। তবে এই পরিসংখ্যান বলছে, নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলে শিক্ষার্থীর তুলনায় শতকরা ১৫-১৮ শতাংশ কম।
রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈষম্যের শিকার চা শ্রমিক শিশুরা: সারাদেশে চা বাগানগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির প্রায় ৯৮টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। কিন্তু সরকারি প্রজ্ঞাপনে নৃগোষ্ঠী হিসেবে সাঁওতাল, মুন্ডা, রাজবংশী, দেশোয়ারাসহ হাতেগোনা কয়েকটি জাতি ছাড়া আর কোনো জাতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে একদিকে যেমন বাগান মালিকদের প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয় থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না চা-শ্রমিক শিশুরা অন্যদিকে সরকারি বিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার তেমন সুযোগ পায় না চা শ্রমিক শিশুরা। এমতবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তাদের ঝরে পরা শুরু হয়। গত বছর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, চা শ্রমিক শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪৯ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।
এছাড়াও চা বাগান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে চা শ্রমিকদের সন্তানদের আশপাশের শিক্ষিতদের সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হয় না, সরকারী বিদ্যালয়েগুলোতেও তাদের সাথে চলে বিভিন্ন শ্রেণিবৈষম্য। আবার অভিভাবকরা বেশিরভাই নিরক্ষর হওয়ায় তারা সন্তানদের শিক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। ফলে শিশুদের পড়ালেখার জন্য বিদ্যালয়ের ওপর তাদের নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু শিশুরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পড়াশোনা না পাওয়া ও বৈষম্যের শিকার হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায়ই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে পড়ালেখা। ফলে অল্প বয়সেই পড়ালেখা ছেড়ে চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে পরছেন শিশুরা।
চা মালিকদের লোক দেখানো উদ্যোগ: চা বাগানের শিশুদের শিক্ষা সহায়তা প্রদানে কাজ করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে একডো। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, ‘চা বাগানের শিক্ষা কার্যক্রম মূলত লোক দেখানো। মালিকপক্ষ চুক্তি আর শ্রম আইনের শর্ত পূরণের জন্য নামমাত্র একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু রাখে। সেখানকার স্কুলগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বেশিরভাগ স্কুলই এক কক্ষের। একটি কক্ষেই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ক্লাস নেয়া হয়। তাও একজনমাত্র শিক্ষক দিয়ে। শিক্ষকের জন্যও আলাদা কোনো কক্ষ নেই এসব বিদ্যালয়ে।
তার ভাষ্যমতে, এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনও থাকে সামান্য। তাই ভালো মানের কোনো শিক্ষক বাগানের স্কুলে কাজ করেন না। ফলে চা বাগানগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান খুবই খারাপ। বাগানের স্কুল থেকে পাস করে আসা শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাইরের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়ই টিকতে পারে না। চা শ্রমিকদের নিয়ে পিএইচডি করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আশ্রাফুল করিম বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে মালিকদের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। স্কুলের নামে একটি ছাপড়া ঘর আর একজন শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই নেই বেশির ভাগ বাগানে। শহর আর মহাসড়কের পাশের বাগানগুলো ছাড়া বাকিগুলোতে সরকারি বিদ্যালয়ও নেই।’
শুধু আইন মানতে দায়সারা শিক্ষা দিয়ে দায়মুক্তি পায় চা বাগান মালিকগণ। ফলে কারিগরি জ্ঞান এবং সঠিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে ঝরে পরে চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের হাজার হাজার শিশুরা।
সরকার করেননা তদারকি: সরকারের শিক্ষা নীতিমালায় সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলেও সারাদেশে ১৬৭ চা বাগানের মধ্যে মাত্র ১২-১৪টিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাকি বাগানগুলোতে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এই নিয়ে গত এক দশকে কোনো তদারকি হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।
সরকার পরিচালিত সিলেটের লাক্কাতুরা বাগানে একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করেন জেনি পাল। তিনি জানান, পড়ালেখার ব্যাপারে শিশুদের আগ্রহ রয়েছে। তবে বাবা-মায়েরা শিক্ষার খরচ বহন করতে পারে না। ফলে পঞ্চম শ্রেণির পরেই ঝরে পরে বেশির ভাগ শিশু।তিনি আরও বলেন, ‘বাগানের প্রাথমিকের পর আর পড়ার সুযোগ নেই। বাইরের বিদ্যালয়গুলোতে পড়ার মতো টাকা তাদের নেই। তাই পঞ্চম শ্রেণির পরই অলিখিতভাবে চা শ্রমিক শিশুদের পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।বাগান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নেই কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারি বিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব জমি থাকা আবশ্যিক পূর্বে এই আইন থাকলে চা বাগান অঞ্চলগুলোর জন্য সাম্প্রতিক এই আইন শিথিল করার পরও বাগানের ভেতর সরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষাসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের কোনো উদ্যোগ প্রতীয়মান হয়নি। বাগানের কিছু বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হলেও সেখানে নেই পড়ালেখার যথাযথ বালাই। সরকারের মহল থেকেও তদারকি করা হয়না মালিক পক্ষের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে কারিগরি শিক্ষাসহ যথাযথ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চা শ্রমিক হাজার হাজার শিশুরা।
শিক্ষার আলো পেতে যেসব দাবি চা শ্রমিক শিশুদের পরিবারের:
• মালিক পক্ষের বেধে দেয়া চা শ্রমিক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাসিক ৪৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকা উন্নীত করতে হবে।
• বই, খাতা, কলম এবং ড্রেসসহ সকল শিক্ষা উপকরণ প্রতিষ্ঠান থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা।
• শিশুদের দুপুরের খাবার প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া।
পর্যপ্ত পরিমাণ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং ক্লাসরুমে শ্রেণিবৈষম্য বন্ধ করা।
• উচ্চ শিক্ষা ও সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে চা শ্রমিক সন্তানদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা।
• পিছিয়ে পরা চা শ্রমিক শিশুদের শিক্ষার আলো নিশ্চিত করতে প্রস্তাবনাসমূহ:
• সরকারের জারি করা আইন প্রতি ২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি বিদ্যালয় বাধ্যতামূলক— এটি কার্যক্রম শতভাগ নিশ্চিত করা।
• প্রতি ১০জন শিক্ষার্থীর অনুপাতে একজন করে শিক্ষক বাধ্যতামূলক করা।
• ন্যুনতম ৩০জন শিক্ষার্থীর হলেই একটি করে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান করা।
• খাতা, কলম, বইসহ সকল শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের মালিকপক্ষ সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠান থেকে।
• সরকার/মালিক পক্ষ থেকে টিফিনে পুষ্টিকর খাবার ‘মিড ডে মিল’ চালু করতে হবে।
• শিক্ষকদের ৬ মাস অন্তর কারিগরি ট্রেনিং এবং যথাযথ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ানো।
উচ্চ শিক্ষার জন্য চা শ্রমিক শিশুদেরও পোষ্য কোটায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
• সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতো চা শ্রমিক শিশুদেরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে সমসুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
চা বাগান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য একটা টিম গঠন করতে হবে।
•১৮ বছর-এর নিচে সকল চা শ্রমিক শিশুদের শিশুশ্রম বন্ধ করার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :