ব্যবহৃত পানির প্রায় অর্ধেক দিয়ে নতুন প্রযুক্তিতে ভালো ফসল ফলানো সম্ভব। নদী পুনঃখনন ও নদীশাসনের জন্য পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করা হলে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ফিরে আসবে, নদীদূষণ রোধে সহায়ক হবে। নদ-নদীর পানি দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ওয়াসার সিউয়েজ নির্গমনসহ নদ-নদীর পানিতে সবরকমের কঠিন, গৃহস্থালি ও স্যানিটারি বর্জ্যের মিশ্রণ রোধ করা অত্যাবশ্যক।
নদীর তীরে শিল্পকারখানা নির্মাণ বন্ধ করাসহ শিল্পকারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করে এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণ এবং মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যের মিশ্রণ প্রতিহত করতে পারলে নদীদূষণ অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
জাহাজভাঙা শিল্পের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ না করলে সমুদ্র ও নদী উপকূলীয় এলাকার পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাসহ নদী দখল ও দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। নদীকে রক্ষার জন্য নদী রক্ষাবাহিনীর সার্বক্ষণিক তদারকি জরুরি। নদ-নদীর ভয়াবহ দখল ও দূষণরোধ করে বাংলাদেশের নদ-নদীর আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ সামগ্রিক পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নত হবে। নদ-নদীর পানি হবে মাছসহ জলজ প্রাণীর নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র। এ কথা অনস্বীকার্য, নদীকে ঘিরেই চলছে সভ্যতার ক্রমবিকাশ।
দজলা তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতার সূচনা দিয়ে পরবর্তীকালে সমৃদ্ধ ইরাকের ক্রমবিকাশ, নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা—এসবই নদীর প্রবাহমান ধারায় মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় নদীর অবদানেরই প্রমাণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালিত হলেও নদী সুরক্ষায় উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। তাই নদীর পানি প্রবাহ সচল রাখতে, নদীদূষণ রোধ করতে প্রয়োজন ব্যক্তিগত, প্রযুক্তিগত ও আইনগত নিয়ন্ত্রণ। দেশের এক সময়ের প্রানোচ্ছল খরস্রোতা নদ-নদীগুলো এখন দখল আর দূষণে বিপন্ন প্রায়।সংশ্লিষ্টদের সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে ইতোমধ্যে নদ-নদীগুলোর বুকে জেগে উঠেছে চর। উজানের পলি জমে বন্ধ হয়ে গেছে প্রবাহ।
অনেক স্থানে মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা এসব নদ-নদীর অস্তিত্ব। একসময়ের নদীকেন্দ্রিক জীবিকায় নির্ভরশীল মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে এখন পেশা বদলে অন্য পেশাতে চলে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই প্রকৃত মৎসজীবীরা বিকল্প পেশায় টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। নদ-নদীর প্রবাহ বন্ধ করে রাজনৈতিক প্রভাবশালী একই সাথে শিল্পগুষ্ঠির মালিকরা খরস্রোতা নদ-নদীগুলো ভরাট করে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেছেন। ফলে দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী ভরাট হয়ে দখল আর দূষণে মৃতপ্রায় বলা চলে। বেশির ভাগ নদ-নদীই অবৈধ দখল, পলি পড়া ও সংস্কারবিহীন অযত্নে ভরা যৌবন হারিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
মাদারীপুর: মাদারীপুরের প্রধান নদ-নদী পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, পালরদী, কুমার, নিম্নকুমার, টরকী ও ময়নাকাটার এখন বেহাল দশা। কোথাও নাব্য সংকট আবার কোথাও দখল আর দূষণে অস্তিত্ব ঝুঁকিতে পড়ছে।কুমার ও আড়িয়াল খাঁ নদের তীরেই গড়ে উঠেছে মাদারীপুর শহর। কুমার নদে বালু ফেলে দখল করে অবৈধ বাড়িঘর, দোকানপাট, করাতকল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করছেন ৫ শতাধিক দখলদার। দখলদারের সংখ্যা বাড়ছে, প্রশাসনের নজর নেই। শিবচরের ময়নাকাটা নদী এখন অস্তিত্বহীন। ময়নাকাটার বুকজুড়ে ফসলের আবাদ। অন্যদিকে কালকিনির টরকী ও পালরদীরও একই দশা। বর্ষায় দু-তিন মাস পানি থাকলেও বাকি সময় থাকে কোথাও হাঁটুপানি কোথাও ফসলের মাঠ। আড়িয়াল খাঁয় জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর।
সিলেট: স্রোতস্বিনী সুরমা একসময় ছিল সিলেটের লাইফলাইন। নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে ওঠেছিলো সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাইকারি হাট, মোকাম। সেগুলো এখনো সরব। পাড়ের এ কোলাহল দেখে নীরবে কাঁদে একসময়ের প্রমত্তা সুরমা। দখল-দূষণ আর ভরাটে সুরমা বিপন্ন। শীতকালে সুরমা রূপ নেয় নালায়। স্থানে স্থানে জেগে ওঠা চরে চাষাবাদ হয় সবজি। কোথাও আয়োজন হয় ক্রীড়ানুষ্ঠানের। বর্ষায় নাব্য হারানো সুরমা তার পানি উগরে দেয় লোকালয়ে। মহানগরের কাজির বাজার ও কালীঘাট এলাকায় নদীর তীরকে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছেন স্থানীয়রা। সারা দিনের উচ্ছিষ্ট এনে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী তীরে ফেলায় ধীরে ধীরে ভরাট হচ্ছে নদী। সুরমার বিভিন্ন অংশ খননে ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হলেও সে কাজ শুরু হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় সিলেটের ৭৮ নদ-নদী খননের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। তার কাজও শুরু হয়নি।
কুষ্টিয়া: দখল-দূষণে কুষ্টিয়ার আট নদ-নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ নদ-নদীর বেশির ভাগই পদ্মা-গড়াইয়ের শাখা হলেও অবৈধ দখল, পলি পড়া ও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ভরা যৌবন হারিয়ে এখন মরা খাল। অন্যদিকে প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অনেক স্থানেই প্রভাবশালীরা নদ-নদীর বুকে পিলার দিয়ে নানারকম পাকা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। সরকারি হিসাবে কুষ্টিয়া জেলায় নদ-নদী ও খাল-বিল দখলকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে।
নাটোর: দখল-দূষণ, ভরাটের কারণে অস্তিত্ব¡ হারিয়ে নাটোরের নারদ, বারনই, নন্দকুঁজা, আত্রাই, গুমানী, বড়ালসহ ৩২টি নদ-নদী মৃতপ্রায়। নদ-নদী এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। পানির অভাবে মিলছে না মাছ। কৃষিকাজে বেড়েছে খরচ। হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার বড়াল, মুছা, নারদ, নন্দকুঁজা, আত্রাইসহ ছোট বড় অধিকাংশ নদ-নদী। জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘নারদসহ নাটোরের নদ-নদীগুলো খনন ও পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী কমিশনসহ স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। কিছু দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিদের উচ্ছেদের কাজ চলছে। ’
সভা করেছি। দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে। কিছু দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিদের উচ্ছেদের কাজ চলছে। ’
লালমনিরহাট: দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী তিস্তাকে উত্তরের জীবনরেখা বলা হয়। এ তিস্তায় এখন দখলের মহোৎসব চলছে। কালীগঞ্জে সোলার পাওয়ার তৈরির নামে নদীর জমি দখল করেছে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার নামে একটি কোম্পানি। শুধু কৃষকের জমি দখল নয়, তিস্তার গলা চেপে ধরার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য নদীর বুক চিরে ২ কিলোমিটার লম্বা ও ৫০ ফুট চওড়া রাস্তা তৈরি করছেন তারা। অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণে তিস্তার বাঁ তীরের চ্যানেলটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
খুলনা: খুলনায় চলছে নদী দখলের উৎসব। প্রভাবশালীরা মহানগরীর রূপসা, ভৈরব, ময়ূর, ডুমুরিয়ার ভদ্রা, হরি, সুখ ও হামকুড়া নদ-নদীর জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা ইটভাটা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, হাঁস-মুরগির খামার তৈরি করেছেন। এর মধ্যে রূপসা নদী দখলমুক্ত রাখতে ২০১৪ সাল থেকে নদীর পাড়ে খাসজমি ইজারা বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। তার পরও নগরীর কাস্টম ঘাট, জেলখানা ঘাট ও নতুন বাজার চর এলাকায় নদীর জায়গা দখল করে বাঁশ, বালু-ইটের গোলা, পাথরের ব্যবসা, পাকা স্থাপনা ও বিশাল ডকইয়ার্ড তৈরি হয়েছে। এখানে ৬১ ব্যক্তি নদীর ৬ একর জায়গা দখলে রেখেছেন। এদিকে ডুমুরিয়ার ভদ্রা, হরি, হামকুড়া নদীর জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা ইটভাটা, দোকানপাট, বাড়িঘর তৈরি করেছেন।
রাজশাহী: রাজশাহীতে পদ্মা নদী দখল রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৯১ অবৈধ দখরদার চিহ্নিত করলেও নানা কারণে তাদের উচ্ছেদ করতে পারছে না। শহরে পদ্মার পাশের এলাকাগুলোর বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি সব ময়লা-আর্বজনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া পাঠানপাড়া, দরগড়াপাড়া, বড়কুঠি, শ্রীরামপুরসহ শহররক্ষা বাঁধের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এসব রেস্তোরাঁর সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন এবং বর্জ্য সরাসরি পদ্মায় ফেলা হয়। তা ছাড়া পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা পার দখল করছে। ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। অনেক স্থানে বাঁধের জায়গা দখল করে নির্মাণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। পদ্মা দখলমুক্ত করতে বা এর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
রংপুর: রংপুর সিটি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী ঘাঘট, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী, বুড়াইল, খোকসা ও আলাইকুমারীর প্রবাহ অবৈধ দখল-দূষণে স্বাভাবিক নেই। শ্যামাসুন্দরীকে কেউ কেউ খাল বললেও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় রাজা জানকীবল্লভ সেন এটি পুনরায় খনন করিয়েছিলেন। দখল-দূষণে এসব নদ-নদী মরে যেতে বসেছে। একসময় এসব নদ-নদী খরস্রোতা থাকলেও এখন অতীত। শ্যামাসুন্দরীর ১৭০ জন দখলদার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চিহ্নিত হলেও রহস্যজনক কারণে উচ্ছেদ অভিযান থমকে রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: পাড় দখল ও দূষণে বিপন্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী। মহানন্দার খালঘাট, গোয়ালবাড়ী থেকে মহানন্দা ব্রিজ পর্যন্ত নদীর পাড়ে বালু ভরাট করে বিক্রি করা হচ্ছে প্লট হিসেবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের সামনেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত খালঘাট। আর তা পার হলেই গোয়ালবাড়ী খেয়াঘাটের দুই পাশে চলছে নদী দখলের মহোৎসব। মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদীতে ১৪৭ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বেতবাড়িয়া মৌজায় দখল করা হয়েছে নদীর প্রায় অর্ধেক। এতে পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক গতিপথ।
নওগাঁ: উত্তরের বৃহত্তর জেলা নওগাঁয় রয়েছে ছয়টি নদ-নদী- আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, শিব, পুনর্ভবা ও নাগর। জেলার অন্যতম নদী ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গায় একসময় সারা বছর পানি থাকত। আত্রাই ও পুনর্ভবা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রতি বছর পলি জমায় ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ এলাকা ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ড্রেজিং না করায় দুই পাড়ের জমি কৃষকসহ প্রভাবশালীরা দখল করেছে। একই অবস্থা অন্যসব নদ-নদীরও।
মেহেরপুর: দূষণ আর পলি পড়ে মেহেরপুরের নদ-নদীগুলো মৃতপ্রায়। জেলার প্রধান দুটি নদ-নদী ভৈরব ও মাথাভাঙ্গা। এদেরই শাখা নদী কাজলা, ছেউটিয়া। এর মধ্যে ভৈরব পুনঃখনন হলেও মাথাভাঙ্গা, কাজলা আর ছেউটিয়া দখলদারদের দৌরাত্ম্যে আজ মৃত। মাথাভাঙ্গা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলাঙ্গী থেকে গঙ্গার শাখা নদী হিসেবে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজীপুর দিয়ে এ দেশে প্রবাহিত। মাথাভাঙ্গা নদীপথ কলকাতার সঙ্গে মেহেরপুর তথা বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল। মাথাভাঙ্গার বিভিন্ন অংশের দখল নিয়ে মালিকানা দাবি করে আসছেন এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।
কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীটি খনন করে লেকে পরিণত করা হয়েছে। অবৈধ দখল, কচুরিপানা আর ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নদীর অস্তিত্বই বিলীন হতে চলেছে। খননের আগের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরও শোচনীয়। নদীতে প্রবাহ না থাকায় কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনা জমে আবারও ভরাট হচ্ছে।
বগুড়া: করতোয়া নদীর তীরঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়াপত্তন হলেও সে সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়াও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত করতোয়া দূষণ-দখল, ভরাট, প্রবাহ না থাকায় এখন মরা নদী। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সদরের খুলশিচাঁদপুরে বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়ার গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। তখন ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখা নদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে করতোয়ার প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে সরু খালে পরিণত হয়। একদিকে পানিশূন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্যদিকে ভরাট আর দখলের ফলে নদীটি এখন মৃত। করতোয়ার শহরের ভিতরের অংশে যে যেখানে পেরেছে দখল ও ভবন নির্মাণ করেছে।
পটুয়াখালী: পটুয়াখালী শহরের প্রাণ লোহালিয়া ও লাউকাঠি নদীর তীর দখল হয়ে যাচ্ছে। কলাপাড়ায় ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক, সোনাতলা, শিববাড়িয়া, খাপড়াভাঙ্গা, আরপাঙ্গাশিয়া ও টিয়াখালী নদী এখন ভরাট ও দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে। প্রভাবশালীরা এসব নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলেছেন ভাটা। তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, ফেলা হচ্ছে সব ধরনের বর্জ্য। পরিবেশসচেতন মানুষ এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
জামালপুর: নদীর উজানমুখে বাঁধ নির্মাণ আর দীর্ঘদিন খনন না করায় অবৈধ দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা নদী ঝিনাই। ঝিনাই নদীর বুকে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, শীর্ণ খালের মতো নদীর যেটুকু টিকে আছে তা-ও যেন অস্তিত্ব হারানোর অপেক্ষায়। প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যেত বলে স্থানীয়রা নদীর নাম দিয়েছিলেন ঝিনাই। ঝিনাইয়ের বুকে একটা সময় বড় বড় বজরা আর পালতোলা নৌকার আসা-যাওয়া ছিল। প্রায় দুই যুগ আগে বাঘলদি এলাকায় ঝিনাই নদীর উজানে বাঁধ দেন স্থানীয়রা। এর পর থেকেই ঝিনাই যৌবন হারাতে থাকে।
মানিকগঞ্জ: অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি এবং উজানে পলি জমায় অভ্যন্তরীণ নদ-নদী মরে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জ শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা কালীগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। একসময় এ নদীতে সারা বছর বড় বড় স্টিমার, লঞ্চ, নৌকা চলাচল করত। দীর্ঘদিন খনন না করায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদী। ভরাট হয়ে চরাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। নদীতে চলছে চাষাবাদ। কোথাও কোথাও নদীর মধ্যে বাড়িঘর করে বসবাস করছেন লোকজন। নদী পরিবর্তনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানচিত্র। নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ভুট্টা, সরিষা কফিসহ নানা ফসল।
চুয়াডাঙ্গা: মানচিত্র থেকে একে একে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে চুয়াডাঙ্গার পাঁচ নদ-নদী। এগুলোর কোনোটা উৎসমুখে পলি পড়ে স্বাভাবিক স্রোতধারা হারিয়েছে, আবার কোনোটা দখলদারের কবলে পড়ে বিলীন হওয়ার পথে। একসময় এসব নদ-নদীর ভরা যৌবন থাকলেও এখন ইতিহাস। জেলার প্রধান নদ-নদী মাথাভাঙ্গা ও ভৈরবে একসময় জাহাজ চলত। কলকাতার সঙ্গে এ অঞ্চলের বাণিজ্য যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নদ-নদী দুটি। অন্যদিকে কুমার নদ এবং নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীও জেলার কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে দীর্ঘ সময়। এগুলোও আজ বিলীনের পথে।
দিনাজপুর: একসময়ের খরস্রোতা পুনর্ভবা, ছোট যমুনাসহ কয়েকটি নদী এখন পানিশূন্য ধু-ধু বালুচরই নয়, পরিণত হয়েছে খেলার কিংবা ফসলের মাঠে। নদীর চরে এখন হাঁটুজল। বর্জ্য ফেলে দূষণ চলছে। দুই তীর দখল করেছেন অবৈধ দখলদাররা। অনেক নদী শুষ্ক মৌসুমে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। জেলার ওপর দিয়ে ১৯টি নদ-নদী প্রবাহিত। এর মধ্যে ছোট-বড় আত্রাই, করতোয়া, কাঁকড়া, ঢেপা, পুনর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতী, ভেলামতী উল্লেখযোগ্য। এখন নদ-নদীগুলো হারাতে বসেছে অস্তিত্ব। অনেক স্থানে নদ-নদী টিকে আছে নামেই। এতে এ অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে।
নড়াইল: নড়াইল শহরের বুক চিরে প্রবাহিত চিত্রা নদী দূষণে বিপন্নপ্রায়। পৌরসভার ড্রেন দিয়ে শহরের ময়লা-আবর্জনা মিশে দূষিত করছে এর পানি। দখলদাররা নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন বসতবাড়ি, দোকানপাট। নাব্য সংকটে চিত্রায় এখন নৌ চলাচল বন্ধ। মাগুরা শহরের উপকণ্ঠে বাঁধ নির্মাণের ফলে মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে চিত্রার প্রবাহ।
পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় ৪৬ নদ-নদী। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদ-নদীর সংখ্যা ৩৩। পাহাড়ি সমতল অঞ্চল হওয়ায় কিছু নদ-নদী বয়ে এসেছে ভারতের পার্বত্যাঞ্চল থেকে। দেশের অন্য কোনো জেলার ওপর দিয়ে এত নদ-নদী প্রবাহিত হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে নদ-নদীগুলো বিলীন হয়ে হয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুকিয়ে যাচ্ছে। মরা নদীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এসব নদ-নদীতে চাষ হচ্ছে বোরো। অধিকাংশ নদ-নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছে হাটবাজার, জেলা ও উপজেলা শহর। দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় শহর গড়ে উঠেছে করতোয়ার তীরে। এ দুই বৃহৎ শহরের সব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে করতোয়ায়। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের সব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় গোবরা নদীতে। নদীটি প্রায় মৃত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সোনাই নদীটি ময়লা-আবর্জনায় জীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্ত নদীটি সাতবর্গ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদে পড়েছে। বাংলাদেশে নদীটির প্রবাহপথের দৈর্ঘ্য ২৪ কিমি। নদীতে সারা বছরই চলত ছোট লঞ্চ, ট্রলার, অসংখ্য নৌকা। এখন জীর্ণশীর্ণ ও মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা: দখলের কবলে পড়ে সাতক্ষীরার বেতনা নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। চর দখল ও নদীগর্ভে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, ইটভাটা, দোকানপাট, কৃষি খামার, মাছের ঘের। প্রবাহ হারিয়ে নদীর এখন মুমূর্ষু দশা। অসংখ্য ইটভাটা ও বেড়িবাঁধ দিয়ে পুরো নদীটিই গিলে খাচ্ছেন প্রভাবশালীরা।
সিদ্ধিরগঞ্জ: প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ গোড়াপত্তন হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। এ নদী নিয়েই এখন গভীর উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জবাসী। নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা মরতে বসেছে। শিল্পকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য নদীতে ফেলে ধ্বংস করা হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। নদীর দুই পাশে অবৈধভাবে ডকইয়ার্ড, গোডাউন, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হওয়ায় নদী দিন দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল, আদমজী, আরামবাগ, শিমরাইল, ডেমরা, কোনাপাড়া, রূপগঞ্জ, তারাবো, যাত্রামুড়া, রূপসী, কুতুবপুর, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৬ হাজারের বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ডায়িং, কেমিক্যাল, পলিথিন বর্জ্য এ নদীতে এসে পড়ে। দূষণে শীতলক্ষ্যার পানির রং কালো হয়ে আলকাতরার রূপ নিয়েছে।
গাজীপুর: জনশ্রুতি আছে- গাজীপুরের চিলাই নদী পাড়ি দিতে গিয়ে চিল ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যে কারণে এর নাম চিলাই। শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তে শুরু হওয়া নদীটি বিভিন্ন পথ পেরিয়ে পুবাইলে বালু নদে মিশেছে। বর্তমানে শীর্ণ এ নদীকে স্থানীয়রা চিলাই খাল হিসেবে জানেন। গাজীপুরের হৃৎপি- এটি। তীরে বাড়িঘর নির্মাণ ও দূষণে শীর্ণ নদীটি। একসময়ের প্রমত্তা চিলাই এখন সরু খাল। দখল-দূষণের মাধ্যমে নদীটির যেন টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে। ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি দখলমুক্ত ও খনন করে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
টঙ্গী: দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তুরাগ নদের অস্তিত্ব। দখল-দূষণ আর ন্যাব্য সংকটই এর মূল কারণ। নদের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন ময়লার ড্রেন! নদের পাশে ঘেরা ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে নাক চেপে। আর এসব ময়লা-আবর্জনার পানির গন্ধে অসুস্থ হচ্ছে অনেকেই। তুরাগতীরের ওয়াকওয়ে পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে। গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ওয়াশিং, ডায়িং, ওষুধ, কেমিক্যাল কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য ও বিভিন্ন কারখানার ময়লা-আবর্জনায় দূষণ হচ্ছে পরিবেশ। কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য কৃষিজমি, খাল ও নদে গিয়ে পড়ছে। তুরাগ দূষণের বিষয়ে গাজীপুর পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, ‘ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানা মালিক অনেকের ইটিপি আছে কিন্তু চালান না। ইটিপি তো আমরা পাহারা দিতে পারি না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নদী মানবখ্যাত প্রখ্যাত পরিবেশবিদ মনির হোসাইন বলেন, প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে থাকা নদ- নদীগুলোকে দখল হতে রক্ষার্থে সিএস নকশা অনুযায়ী দ্রুততার ভিত্তিতে অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে দখল মুক্ত করে প্রানোচ্ছল খরস্রোতা নদ-নদীগুলোকে পূর্বের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে ।তিনি আরো জানান,একসময়ের প্রানোচ্ছল এসব নদ-নদী বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি ।অবৈধ দখলে থাকা দেশের সবকটি নদী দখল মুক্ত হয়ে নদীগুলো স্বাভাবিকতা ফিরে পেলেই নদ-নদী বাঁচাতে আমাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম সফল ও স্বার্থক হবে ।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :