পহেলা বৈশাখ—বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বিদায় জানাচ্ছি ১৪৩১ সালকে, আর নতুন আশা ও সম্ভাবনা নিয়ে বরণ করে নিচ্ছি ১৪৩২ বঙ্গাব্দকে।
এক সময় পহেলা বৈশাখ মানেই ছিল ব্যবসায়ীদের হালখাতা, নতুন খাতা খুলে পুরনো দেনা-পাওনা মেটানোর সুযোগ। ডিজিটাল যুগে সেই চিত্র বদলেছে বটে, তবে বর্ষবরণের আনন্দ-উৎসব, ঐতিহ্য আর প্রাণের মেলবন্ধনে পহেলা বৈশাখ এখনও বাঙালির আত্মপরিচয়ের গর্বিত বহিঃপ্রকাশ।
পহেলা বৈশাখ—আত্মশুদ্ধির আহ্বান
নতুন বছর আমাদের আহ্বান জানায়—পুরনো সব গ্লানি, ক্লেদ ও সংকীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে, নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার। “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”—এই কবি রবীন্দ্রনাথের বাণী যেন পহেলা বৈশাখে নতুন তাৎপর্যে প্রাণ পায়।
বাংলা বছরের প্রথম দিনটি আমাদের কেবল উৎসব নয়, আত্মশুদ্ধি, উদারতা ও সহনশীলতা ধারণ করার প্রেরণাও জোগায়। বাঙালির চেতনায় এই দিনটি এক গর্বিত ইতিহাসের ধারক ও বাহক।
বাংলা বর্ষপঞ্জির জন্ম ও তাৎপর্য
ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলা সনের জন্ম কৃষি সভ্যতার বিকাশের হাত ধরেই। বাঙালি কৃষকের জীবন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় বর্ষপঞ্জির ভূমিকা ছিল নিয়ন্ত্রক। কৃষিকাজে সুবিধার্থে প্রাকৃতিক সৌরচক্র ও স্থানীয় প্রয়োজন বিবেচনায় বাংলা সন চালু হয়।
পরবর্তীতে মোঘল সম্রাট আকবর হিজরি সালের অসামঞ্জস্য দূর করে খাজনা আদায়ে উপযোগী নতুন এক সনের প্রয়োজন বোধ করেন। তখনকার খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও হিজরি বছরের সমন্বয়ে প্রবর্তন করেন একটি বর্ষপঞ্জি—যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় “বঙ্গাব্দ” নামে।
১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে এই সন গণনা শুরু হলেও কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে—সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিন। প্রথমে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হলেও সময়ের সাথে পরিচিতি পায় ‘বাংলা বর্ষ’ নামে।
সর্বজনীন উৎসবের প্রতীক
পহেলা বৈশাখ এখন কেবল কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দিন নয়, এটি আজ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব। শাড়ি-পাঞ্জাবিতে রঙ ছড়ানো, মুখে ফুলকি, গালে আলপনা আঁকা আর পান্তা-ইলিশের আয়োজন—সব মিলিয়ে পহেলা বৈশাখ আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকা এক বিশুদ্ধ অনুভব।
ঢাকার রমনার বটমূল থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও নববর্ষ আজ বাঙালির সার্বজনীন সম্পদ। শহরের অলিগলি থেকে মঞ্চে, টেলিভিশন পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার, মঙ্গল শোভাযাত্রা আর বৈশাখি মেলায় রূপ নেয় জাতিগত ঐক্যের মহাউৎসবে।
নববর্ষে প্রত্যাশা
নতুন বছরের প্রভাতে আমরা চাই—একটি সাম্যভিত্তিক সমাজ, যেখানে থাকবে না কোনো বিভাজন, গ্লানি কিংবা ক্ষোভ। আমরা চাই সহনশীল, মানবিক, শান্তিপূর্ণ একটি বাংলাদেশ—যেখানে বাঙালিয়ানার গৌরব বহমান থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
আসুন, বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ আমাদের জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও মানবিকতা। শুভ নববর্ষ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :