রাজধানীর ধোলাইখাল মোড়ে শনিবার অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের হামলায় আহত হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন তিনি। এদিন সংঘর্ষে আহত দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানকে দেখতে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি প্রতিনিধি দল। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান (লিকু) খাবার ও একটি ফলের ঝুড়ি পৌঁছে দেন। এ দুটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ নানা মহলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। রাজপথে মেরে আবার আপ্যায়নের পেছনে নানা কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা। কেউ কেউ দুই নেতার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ করলেও দলটির হাইকমান্ড ও বিভিন্ন স্তরের নেতারা তা আমলে নিচ্ছেন না।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘দলের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। নেতাকর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে এবং ভিসানীতি থেকে বাঁচতে সরকার এ নাটক সাজিয়েছেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমান উল্লাহ আমানও বলেছেন, ‘নেতাকর্মীদের বিভান্ত করতে নাটক সাজানো হয়েছে।’
শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশান কার্যালয় থেকে অবস্থান কর্মসূচির বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। তখন তিনি গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের আহত হওয়ার খবর পান। সেখানে উপস্থিত এক নেতা জানান, তাকে পেটানোর ভিডিও দেখে বিএনপি মহাসচিব চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। পরে বিকালে যখন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে তার নয়াপল্টনের অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়, তখন তাকে ফোন করেন মহাসচিব। ফোনে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করে আবারও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মহাসচিব। কীভাবে এটা সম্ভব?-ফোনে এ কথা বলার সময় মহাসচিবের চোখ থেকে পানি পড়তে দেখা যায়। রোববার দুপুর ১২টার দিকে নয়াপল্টনে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে দেখতে যান তিনি।
একমাত্র মৃত্যু আন্দোলন থেকে আমাকে থামাতে পারবে-গয়েশ্বর : রোববার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘একমাত্র মৃত্যু চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে আমাকে থামাতে পারবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে চলমান গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন আমাকে চিতায় না তোলেন। ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা, চিতায় ওঠার আগে যেন এই সরকারের পতন দেখে যেতে পারি।’
শনিবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর ধোলাইখালে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে সড়কে ফেলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে পুলিশ। পরে তাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে যে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল, সেই খাবার গ্রহণ করেননি বলে জানান গয়েশ্বর। তিনি জানান, ‘ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের জন্য বাসা থেকে পাঠানো খাবার তিনি খেয়েছেন।’ গয়েশ্বর জানান, ‘ডিবি কার্যালয়ে তার জন্য যে খাবারের আয়োজন করা হয়, তা তার স্বাস্থ্যের পক্ষে উপযোগী ছিল না। এ ছাড়া এই খাবার নিয়ে তার সন্দেহও ছিল। সে কারণে তিনি ওই খাবার গ্রহণ করেননি।’
গয়েশ্বর বলেন, ‘ডিবি প্রধানের (অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ) অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সৌজন্যতা রক্ষায় হারুনের জন্য বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার থেকে ভাতসহ হালকা সবজি ও রুই মাছের একটি টুকরা গ্রহণ করি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আরও বলেন, ‘ডিবি প্রধান আমাকে অনুরোধ করেছেন, রুই মাছটি তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেহেতু ডিবি প্রধান নিজেই খাবারটি খাচ্ছেন, তখন আমার মনে হলো, এটা যদি গ্রহণ করি, তাহলে সমস্যা হবে না।’
তখনকার পরিস্থিতিতে খাবার না খেয়ে উপায় ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ডিবি অফিস বিষ দিলে বিষও খেতে হয়।
তিনি বলেন, ‘পুলিশের ছোড়া ইটের আঘাতে মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। সেদিকে খেয়াল না দিয়ে নেতাকর্মীদের রক্ষায় বুক পেতে দিয়েছিলাম। এই অবস্থায় আমাকে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে সাপ পেটানোর মতো পেটানো হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। আহত অবস্থায় আমাকে পুলিশ একটি দোকানে নিয়ে রক্ত মুছে দেয়। যাতে গণমাধ্যমকর্মীরা রক্ত দেখতে না পায়। এ অবস্থায় ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে আমাকে আপ্যায়ন করে। সেটার ছবিসহ ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় পুলিশ।’ এ ঘটনাকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেন বিএনপির এই নেতা।
তিনি আরও বলেন, ‘যারা এ কাজটি করেছে, এটি অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচায়ক। এক ধরনের তামাশাপূর্ণ নাটক। এতে কি সরকার প্রমাণ করতে চায় যে, আমরা হা-ভাতে? ভিক্ষা করে খাই? গ্রামের ভাষায় বলা হয় ‘খাইয়ে খোঁটা দেওয়া।’ ডিবি অফিসে আমার সঙ্গে যা করা হলো তা ওই রকমই। আমার বাড়িতে তো বিভিন্ন সময় অনেক লোক খায়। এটা আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের। কিন্তু এই খাবারের ছবি উঠিয়ে কি আমি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেব? এটা কি আমার জন্য ভালো হবে।’
গয়েশ্বর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘সরকারের কোনো প্রলোভন গয়েশ্বরকে কিনতে পারবে না। সরকারের কাছে এত টাকা নেই যে, গয়েশ্বরকে কিনতে পারে। সরকার গ্রেফতার করতে পারে, এমনকি প্রাণও নিতে পারে-এই শক্তি সরকারের রয়েছে। কিন্তু গয়েশ্বরকে কিনতে পারবে না।’
চলমান জনসম্পৃক্ত আন্দোলন সফল হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন গয়েশ্বর রায়। তিনি দাবি করেন, শনিবার বিকাল ৩টার দিকে ডিবি কার্যালয় থেকে নয়াপল্টনে নিজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়। তখনো তার কাছ থেকে কিছু লেখা একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয় ডিবি।
নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার জন্য নাটক সাজানো হয়েছে-আমান: শনিবার বিকালে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটি গাড়িতে আমানউল্লাহ আমান ফেসবুক লাইভে কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘আহত অবস্থায় হাসপাতালে থাকার সময় ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এমন সময় কে বা কারা তাকে দেখতে এসেছিল এবং ফলের ঝুড়ি দিয়ে গেছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। চলমান আন্দোলনে তার ভূমিকার পিঠে ছুরি মারার জন্য, নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আমান বলেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলনে আছি। এতে মৃত্যু হলেও পিছপা হবো না। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে আবারও ভর্তি করানো হয় আমানউল্লাহ আমানকে। বর্তমানে তিনি সিসিইউতে আছেন।
একুশে সংবাদ/য/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :