বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস আয়োজিত মহান মে দিবস স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সকল শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরি সহ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বিগত একযুগে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবে এর সামান্যই এদেশের অজস্র সাধারণ শ্রমিক পেয়েছেন, তাদের আয়-বৈষম্য বৃদ্ধিই তা অনেকাংশে বলে দেয়। তিনি মন্তব্য করেন, মূল্যস্ফীতির উঁচু মাত্রার কারণে বিগত প্রায় দুই বছর ধরে স্বল্প আয়ের মানুষদের উপর চাপ অনেক বেড়েছে। সুতরাং, বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের ঘোষিত যে নীতি রয়েছে সেটি বাস্তবায়নের দিকে নজর দেয়া জরুরি।
আজ রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিক্স এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিলস এর ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ মজিবুর রহমান ভূঞাঁ, স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। অনুষ্ঠানে জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজ ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং পেশাজীবি সংগঠনসমুহের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
শিল্পের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মজুরি পরিবারের সকলের শোভন জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত কিনা এ প্রশ্ন রেখে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, তৈরী পোশাক খাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়, বৃদ্ধির অনুপাতে যা উল্লেখযোগ্য, কিন্তু পারিবারিক শোভন জীবন-ধারন বিবেচনায় যে অংক বাড়ানো হয়েছে তা অপ্রতুল, আর অব্যাহত মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বর্তমান মজুরি নিতান্তই অপ্রতুল। তিনি বলেন, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭০ টাকা করা হলেও এর ভিত্তি এত স্বল্প যে এই বৃদ্ধি প্রকৃত অর্থে তেমন কিছুই নয়। তিনি মন্তব্য করেন, ভারতে শিল্প ও সামাজিক সুরক্ষা আইন ও বিধিমালার আওতায় চা শ্রমিকরাও সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। সুতরাং, বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের জীবনমান শোভন পর্যায়ে উন্নয়নের দাবি রাখে।
খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, যে ৮৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে তাদের মধ্যে শ্রমিকদের ৮৫ শতাংশ না হলেও ব্যাপক সংখ্যক মানুষ শ্রমিক। এদের বেলায় শ্রমআইন, বিধিমালা, নিয়োগপত্র, নির্ধারিত মজুরি, আর্থিক সুবিধা, ছুটির ধারণা, আইনি অধিকার ও বিধি-বিধান ছুঁয়ে যায় না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আগে থেকে কমে গেলেও বর্তমানে দেশে মোট শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশই কৃষিশ্রমিক। তিনি আশা করেন, আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট সকলে কৃষিশ্রমিকের যৌক্তিক দাবিগুলো জোরদারভাবে উত্থাপন করবেন এবং সরকার সংবিধানের তাগিদ ও আইনের অনুশাসন অনুযায়ী তাদের সব যৌক্তিক অধিকার নিশ্চিত করবে।
কুটির শিল্প ও মাইক্রো উদ্যোগ ও ব্যবসার দিকেও নজর দেয়ার প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে খলীকুজ্জমান মন্তব্য করেন, এক্ষেত্রে মালিকদেরকে অতি প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও শ্রমিকদের আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার দিকে নজর দিতে হবে।
অনানুষ্ঠানিক খাতে বিদ্যমান গৃহকর্মীদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সরকারি মনিটরিং সেলকে কার্যকর ও পরিদর্শন কার্যক্রম চালু করার কথা নীতিমালায় থাকলেও এখন পর্যন্ত এই নীতিমালা মূলত কাগজেই রয়ে গেছে। বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেছে সামান্যই। গৃহকর্মীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে নীতি বাস্তবায়নে অনেক সময় ঘাটতি থাকে। নীতিমালা আসলে দিকনির্দেশনা, এতে বাধ্যবাধকতা থাকে না। এদেশে আইনও অনেক সময় প্রয়োগ করা হয় না। তবে আইন থাকলে তার আওতায় ভুক্তভোগীরা সেই আইনের আশ্রয় নিয়ে প্রতিকার চাইতে পারেন।
শ্রমিকদের ন্যায্য দাবীর বিষয়টি সর্বোচ্চ বিবেচ্য হিসেবে উল্লেখ করে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবীর সাথে যে সমস্ত শ্রমিক সংগঠন একাত্ম থাকতে পারে নি, তারা বিলীন হয়ে গেছে। তারা বলেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা এখনও শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন এবং তারা এখনও বৈষম্যের শিকার, বিশেষ করে ন্যায্য মজুরি, আইনী মর্যাদা ও সামজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। সরকার অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের নামে শ্রমিকদের অধিকারকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে বলেও তারা মন্তব্য করেন। তারা বলেন, অতীতে সংঘবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার অর্জিত হয়েছে, তাই বর্তমানেও অধিকার আদায়ে সংঘবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই।
উল্লেখ্য, বিলস এর উদ্যোগে মহান মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে “মহান মে দিবস স্মারক বক্তৃতা”র আয়োজন করা হয়ে থাকে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে মে দিবসের চেতনার সাথে সমুন্নত রাখা এবং বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক আন্দোলনের করণীয় বিশ্লেষণে এই স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ পর্যন্ত বিলস আয়োজিত মে দিবসের স্মারক বক্তৃতায় সর্বজনাব কামাল লোহানী, শেখর দত্ত, এম এম আকাশ, মঞ্জুরুল আহসান খান সহ বিভিন্ন গুণীজন তাদের বক্তব্য প্রদানের মধ্যে দিয়ে বিলস এর এই আয়োজনকে সমৃদ্ধ করেছেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এ বছর অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য “বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়, শ্রমিকের ন্যায্যহিস্যা নিশ্চিত কর”।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :