রাত পোহালেই গাজীপুরে শুরু হবে নির্বাচন। বৃহস্পতিবারের (২৪ মে) ভোটে নির্ধারিত হবে কে হচ্ছেন আগামী দিনের নগরপিতা। দিনশেষে জানা যাবে কারা হচ্ছেন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর।
মেয়র পদে প্রার্থী আছে আটজন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান এবং সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের মধ্যে। এ নির্বাচনে আজমত উল্লা খান দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ এবং জায়েদা খাতুন ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন।
মঙ্গলবার তাদের কাউকে বড় ধরনের শোডাউন করতে দেখা যায়নি। স্থানীয়রা জানান, এবারের নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের উৎসাহ কম থাকলেও আছে চাপা আতঙ্ক। ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। প্রতি কেন্দ্রে থাকবে সিসি ক্যামেরা। গাসিক নির্বাচনে ৪৮০ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শেষ হয়েছে। ৯ মে থেকে টানা ১৫ দিন প্রচার চালিয়েছেন প্রার্থীরা। প্রচারের শেষ দিনে মেয়র প্রার্থীদের কেউই শোডাউন বা বড় ধরনের জনসমাগম করেননি। প্রধান দুই মেয়রপ্রার্থী আজমত উল্লা খান ও জায়েদা খাতুন অনেকটাই নীরব প্রচার চালান। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিনকে দিনভর প্রচার চালাতে দেখা গেছে। অপরদিকে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। কোথাও কোথাও জনসমাবেশ ও মিছিল হয়েছে।
মঙ্গলবার ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে টঙ্গীর কলাবাগান বস্তি এলাকায় স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনির প্রচারে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা বাধা দিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। সোমবার রাতে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারদলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আজিজুর রহমান ও তার সমর্থকরা পূবাইল কলেরবাজার এলাকায় মিছিল ও জনসমাবেশ করেন। ওই সমাবেশে ‘নৌকা ছাড়া কাউকে কেন্দ্রে আসতে দেবেন না’ বক্তব্য দেওয়া হয়। এছাড়াও কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে বিরোধী মতের প্রার্থীর সমর্থকদের সাদা পোশাকে পুলিশ ধরে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। সবমিলিয়ে গাজীপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছে।
এই নির্বাচনের ৪৮০টি কেন্দ্রের সবকটিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে। এবার সব কেন্দ্রে থাকবে সিসি ক্যামেরা। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে সরাসরি সিসি ক্যামেরায় ভোটগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করবে ইসি। এর আগে ২০১৮ সালের ২৬ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছয়টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। সেসময় কিছু কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরাও ছিল। তবে ওই নির্বাচনে সহিংসতায় কয়েকটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়েছিল। এবার ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৭ জন সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ভোটের ব্যালটে নৌকা ও টেবিল ঘড়ি প্রতীক থাকলেও নির্বাচনি মাঠে বাস্তবে আজমত উল্লা খান এবং সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে লড়াই হচ্ছে। জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় তিনি মাকে নিয়ে এ নির্বাচনে লড়ছেন। মায়ের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তার জানান দিতে চাচ্ছেন জাহাঙ্গীর আলম। যদিও জায়েদা খাতুন জীবনে প্রথমবার নির্বাচন করছেন। রাজনীতিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল না। অপরদিকে আজমত উল্লা খান সাবেক টঙ্গী পৌরসভার তিনবারের মেয়র ছিলেন। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা ও পর্যবেক্ষক মহলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এ নিয়ে তৃতীয়বার নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম দুই নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ কম। অনেকের মধ্যে আছে চাপা আতঙ্ক। এর কারণ হিসাবে তারা জানান, এই প্রথম বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হচ্ছে। দলটির ২৯ জন নেতা কাউন্সিলর পদে ভোট করায় তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। দলটির নেতাকর্মীরা তাই প্রকাশ্যে মাঠে নামেননি। অপরদিকে আজমত উল্লা খান ও জাহাঙ্গীর আলম রাজনীতিতে একই ঘরানার হওয়ায় তাদের নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হলেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। আজমত উল্লা খান নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারলেও জায়েদা খাতুনের প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, আমারা বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিকদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারছি যে যারা দীর্ঘদিন গাজীপুরের স্থায়ী বাসিন্দা, তারা এই নির্বাচন নিয়ে নির্লিপ্ত। তবে ভাসমান ভোটারদের মধ্যে আগের চেয়ে গত এক সপ্তাহে আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ভোটের দিন কী যেন হয়। ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না, সেই আশঙ্কাও আছে। এছাড়া নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েও মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। শ্রমিকপ্রবণ এই এলাকার মানুষ ইভিএমে ভোট দিতে অভ্যস্ত নন। শিশির বলেন, এ নির্বাচনে বিরোধী দল অনুপস্থিত। সরকারি দলের প্রার্থী একচেটিয়া প্রচার চালিয়েছেন। অন্যদের প্রচার তেমন চোখে পড়েনি।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি ভালো ও সন্তোষজনক রয়েছে বলে দাবি করেন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো। নির্বাচনি মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। তাদের পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও আছেন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৬-১৭ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী মতের কর্মী-সমর্থকদের তুলে নেওয়া এবং ভয় দেখানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে এমন বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। কয়েকজন প্রার্থী কিছু অভিযোগ দিয়েছেন। সেই অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে ৪০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আজিজুর রহমানকে তলব করেছে নির্বাচন কমিশন।
একনজরে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আটজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে ২৪৬ জন এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ফয়সাল আহমেদ সরকার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪৮০টি এবং ভোটকক্ষ ৩৪৯৭টি। মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২, নারী ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১৮ জন। নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ১০ হাজার ৯৭০ জন। প্রিসাইডিং অফিসার ৪৮০, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ৩৪৯৭ এবং পোলিং অফিসার ৬৯৯৪ জন।
৩৫১টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ : ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাকি ১২৯টিকে সধারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসাবে ৭৩ শতাংশ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় বাড়তি ফোর্স মোতায়েন করেছে ইসি। মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। তিনি বলেন, কোনো থ্রেড না থাকলেও যেহেতু শিল্প এলাকা, তাই দুষ্কৃতকারী বা অসৎ উদ্দেশ্য যাদের থাকে, তারা যেন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, তাই অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিল্প এলাকা বিধায় গাজীপুর সিটিতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ বসবাস করেন। তাই মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও বেশি। তবে নির্বাচনি পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ভালো। তিনি বলেন, কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে সে যে দলেরই হোক, তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। অনিয়মের মাত্রার ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কী নেওয়া হবে, তা নির্ভর করবে। এই কমিশনার বলেন, নির্বাচনি এলাকায় র্যাবের ৩০টি টিম এবং ১৩ প্লাটুন বিজিবি রয়েছে। এছাড়া পুলিশের ১৯টি স্ট্রাইকিং ফোর্স এবং ৫৭টি মোবাইল টিম রয়েছে।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহাঙ্গীর
আপনার মতামত লিখুন :