বর্জ্য দূষিত করছে পানি ও পরিবেশ। তাই বর্জ্যকে বিকল্প পন্থায় ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার আমিন বাজারে দেশের প্রথম ইনসিনারেশন প্ল্যান্টের (ভস্মীকরণ কেন্দ্র) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হবে আগামীকাল (২০ জুলাই)। আগামী ২০২৫ সালের অক্টোবরে বর্জ্য থেকে ৪২. ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। শিগগিরই এই প্ল্যান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা রয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশে দৈনিক প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজর হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বর্জ্য পরিবেশে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
ঢাকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক দশক আগে ইতালিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়। শুরুতে ৪৮ মেগাওয়াট, পর্যায়ক্রমে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা ছিল তখন। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামসহ সব সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে অনেক বার বৈঠক করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এসব বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পর্যায়ক্রমে সব সিটিতেই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
এবিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ইতালির কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট এনভায়রনমেন্ট ফিন্যান্স এসআরএলের সঙ্গে চুক্তি করেছিল এলজিআরডি। এটা ২০১৩ সালে। ঢাকার বর্জ্য দিয়ে দৈনিক ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা ছিল কোম্পানিটির। পর্যায়ক্রমে তা বাড়িয়ে ১০০ মেগাওয়াট করার পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু দশ বছর আগে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি চুক্তি করা ইতালিয়ান কোম্পানিটি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে ‘বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠান সামনে রেখে গত ১৫ জুনসচিবালয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়।
সভায় জানানো হয়, দেশে প্রচুর বর্জ্য হচ্ছে কিন্তু সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। যে কারণে সরকার বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতিতে গেছে। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ২০২১ সালে চায়না মেশিনারিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চুক্তি হয়। ওই চুক্তির আওতায় চীনা ওই কোম্পানিকে আমিন বাজারে ৩০ একর জমি দেয়া হবে। সেজন্য ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আমিন বাজারে ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
চুক্তির আওতায় প্রতিদিন তিন হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সরকারের এখানে কোন আর্থিক বিনিয়োগ থাকবে না। এই প্ল্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নেবে বিদ্যুৎ বিভাগ। বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আমিন বাজারের মতো একই ধরনের উদ্যোগ চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে নেয়া হয়েছে।
প্রতিদিন ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ-
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), স্থানীয় সরকার বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে এ বিষয়ে কাজ করছে। ইনসিনারেশন ব্যবস্থা অনুসরণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে বর্জ্য নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে পরিবেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন থাকে। ঢাকার আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে এই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে। প্রতিদিন ৩০০০ টন মিক্সড বর্জ্য থেকে ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। স্পন্সর হিসেবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ইনসিনারেশন প্ল্যান্টে যুক্ত থাকবে। এই প্রকল্প আগামী ২৪ মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ২৫ বছর পর্যন্ত কিনে নেবে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ডিএনসিসি ৩০ একর জায়গা দিয়েছে। সেখানে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করা হবে। বর্জ্য সরবরাহ করতে হবে বিনামূল্যে। উৎপাদিত ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পিডিবি চুক্তি মূল্য অনুযায়ী কিনে নেবে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। উৎপাদনে ডিজেলের চাইতেও খরচ কম হবে। ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে উৎপাদনে যেতে পারবো বলে আশা রাখি। অন্যান্য সিটি করপোরেশনেও একই প্রক্রিয়া চলমান।২০২৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে এ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
৩ হাজার ডলার জরিমানা-
প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য ল্যান্ডফিলে পৌঁছে দিতে না পারলে উৎপাদকদের ৩ হাজার ডলার করে জরিমানা দিতে হব । তেমনি তারা প্রতিদিন সাড়ে ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারলে তাদের থেকে প্রতিদিন ৩ হাজার ডলার জরিমানা হিসেবে পাওয়া যায়। বর্তমানে প্রতিদিন ডিএনসিসি এলাকায় সাড়ে ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি -
দাম কিছুটা বেশি হলেও ভর্তুকি দিবে সরকার। এই বিদ্যুৎ পরিবেশবান্ধব। এর দাম প্রতি ইউনিট ২১ টাকার বেশি পড়বে। সরকার এখানে একটা সাবসিডি (ভর্তুকি) দেবে।দাম বেশি হলেও এতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, অন্যদিকে পরিবেশের জন্য হুমকিতে থাকা বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা হবে।
এবিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় দিনে সাড়ে তিন হাজার টন মিশ্র বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রী, হিউম্যান ও অ্যানিম্যাল বডি বাদ দিয়ে অন্যান্য বর্জ্য প্ল্যান্টে সরবরাহ করা হবে।
এবিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নজরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বহুবার, গত ১০-১১ বছর যাবত চেষ্টা হচ্ছিল। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগ ও সহযোগিতার কারণে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে যাচ্ছে।কেবলমাত্র ঢাকা শহরের উত্তর না, আমরা চেষ্টা করছি ঢাকার দক্ষিণ অঞ্চলে করার। ইতোমধ্যে ময়মনসিংহ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৪ বছর আগে দেয়া হয়েছে, কোভিডের কারণে সেখানকার ঠিকাদার এখনও জায়গা বুঝে নিয়েছেন কিন্তু কাজ শুরু করতে পারেননি।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বহুবার, গত প্রায় ১০-১১ বছর যাবত চেষ্টা হচ্ছিল। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগ ও সহযোগিতার কারণে আজকে এটা সম্ভব হচ্ছে। সম্পূর্ণ বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় তা আমাদের বিদ্যুৎ খাতকে আরো শক্তিশালী করবে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বর্জ্য নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইনসিনারেশন ব্যবস্থা অনুসরণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে বর্জ্য নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যাতে পরিবেশ সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন থাকে। ঢাকার আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে এই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট নির্মাণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ৪২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রতিদিন ৩০০০ টন মিক্সড বর্জ্য থেকে উৎপাদন করা হবে। স্পন্সর হিসেবে চায়না মেশিনারী ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ইনসিনারেশন প্লান্টে যুক্ত থাকবে। এ প্রকল্প আগামী ২৪ মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ২৫ বছর পর্যন্ত ক্রয় করবে। এ প্রকল্পের সর্বমোট ধরা হয়েছে তিনশত মিলিয়ন ইউএস ডলার।
তিনি বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধারণা ও অভিজ্ঞতা। টেকসই উন্নয়নের জন্য এ ধরনের প্রকল্পের বিকল্প নেই। এ প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন আমাদের বর্জ্য নিষ্পত্তি হবে তেমনি বিদ্যুতের মতো অতি প্রয়োজনীয় শক্তিও আমরা উৎপাদন করতে পারব যা আমাদের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার কিছুটা সংকুলান হবে।
একুশে সংবাদ/আ.জ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :