১৪ বছরের সংসার জীবন জামাল-সামিয়া দম্পতির। ভাড়া থাকেন রাজধানীর দয়াগঞ্জ এলাকায়। বেসরকারি চাকরিজীবী স্বামীর একক উপার্জনেই এতদিন মোটামুটি সচ্ছলভাবেই সংসার চলেছে তাদের। তবে সব ধরনের নিত্যপণ্য ও বাসা ভাড়াসহ জীবনযাত্রার আনুষঙ্গিক খরচাদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত অন্যান্য পরিবারের মতো তারাও পড়েছে মহাবিপাকে। তাই স্বল্প শিক্ষিতা সামিয়া গত কয়েক মাস ধরে উচ্চবিত্ত প্রতিবেশীদের তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা উপার্জনের চেষ্টা করছেন।
রায়েরবাগের বাসিন্দা করিমুন নেসা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মৃত স্বামীর পেনশনের টাকায় সন্তানদের নিয়ে অনেকটা সচ্ছলভাবেই সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আর্থিক টানাপোড়েন রূপ নিয়েছে। সংসার সামাল দিতে তাই পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বিধবা নারী এখন ছোটখাটো কোনো কাজ খুঁজছেন।
শুধু সামিয়া - করিমুন নেসা নয়, তাদের মতো হাজার হাজার মধ্যবিত্ত মানুষ এখন বিকল্প আয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। তবে এর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক মানুষ উপযুক্ত কাজ জুটিয়ে নিতে পেরেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ অর্ড জব-এ যোগ দিয়েছে। কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙে ছোটখাটো দোকান খুলে বসেছে। অনেকে বাসায় রান্না করা খাবার অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাঝারি মানের চাকরি করা অনেক মানুষ এখন কর্মস্থল থেকে ছুটির পর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম কাজ খুঁজে নিয়েছে। তবে কাজ যোগাড় করতে না পারা মানুষের মিছিল এখনো অনেক দীর্ঘ রয়ে গেছে।
এদিকে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষ। কেবল নিম্নবিত্তরাই নয়, কুলিয়ে উঠতে পারছে না মধ্যবিত্তরাও।
বাজারের তালিকায় কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। তেলের পর মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাল, ডাল, আটাসহ আরও অনেক পণ্য। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষ।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েকটি যৌক্তিক কারণ বাদ দিলে কিছুঅসাধুব্যবসায়ী বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। এ অবস্থায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
শনিবার (২৬ আগস্ট) কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘোরা অনেকে এ প্রতিবেদককে তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। কালিমুল ইসলাম নামের এক এনজিও কর্মকর্তা জানান, বছর তিন-চার আগেও তিনি বেশ কয়েকবার পার্টটাইম জব পাল্টেছেন। এক কাজ ছেড়ে আরেক কাজ পেতে ওই সময় তার সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগেছে। অথচ গত ৭/৮ মাস ঘুরেও তিনি এখন ছোটখাটো কোনো বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে বের করতে পারেননি।
কালিমুল ইসলাম জানান, তার বাসার কাছের একটি বড় চেইন শপে করোনার সময় মাস চারেক হিসাব রক্ষকের চাকরি করেছিলেন। অন্য কোথাও কাজ না পেয়ে সম্প্রতি তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তবে ওই চেইন শপের মালিক তাকে চাকরি দিতে অপারগতা জানান। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, মালিকের শ্যালকই এখন ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি সেখানে পার্টটাইম কাজ করছেন।
শনির আখড়ার একটি ফাস্টফুডের দোকান মালিক বোরহান বলেন, দোকানের আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় নিজের স্ত্রীকেই এখন ক্যাশ কাউন্টারে বসিয়েছেন। ফুড ডেলিভারিতে কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে পার্টটাইম কাজে লাগিয়েছেন। মধ্যম মানের চাকরি ও ব্যবসা করা অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মী এখন তার কাছে বিকল্প কাজের সন্ধান করছেন।
এদিকে, অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বিকল্প আয়ের উৎস খোঁজা মানুষের তালিকা শিগগিরই আরও দীর্ঘ হবে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, বিভিন্ন জায়গায় যারা ছোটখাটো ও পার্টটাইম কাজের খোঁজে ছোটাছুটি করছেন, তাদের সবাই বিকল্প আয়ের সন্ধান করছেন এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। এদের মধ্যে অনেকে পুরোপুরি বেকার। তবে যোগ্যতা অনুযায়ী আশানুরূপ কাজ না পেয়ে তারা এখন যে কোনো কিছু করে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করছেন। এ সংকট আরও ঘনীভূত এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদরা বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে মন্দাভাব বিরাজ করছে, তার জেরে বিনিয়োগ কমবে; বাড়বে বেকারত্ব। শ্রমের মূল্য কমে যাবে। কলকারখানা ও কৃষি উৎপাদনশীলতাও কমবে। এতে খাদ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। ফলে সংসার সামলাতে পরিবারের উপার্জনাক্ষম ব্যক্তিকে বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। অনেকে বাধ্য হয়ে অশিক্ষিত কিংবা স্বল্প শিক্ষিত গৃহিণী এবং শিশু সন্তানদের অর্থ উপার্জনে কাজে লাগাবে।
এদিকে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দায় অর্থনীতির গলায় বেকারত্বের কাঁটা আগামীতে আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা কথা জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, বাসাবাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়ে, মুদি দোকান খুলে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ৪/৫ ঘণ্টা কাজ করে যে স্বল্প আয় তা দিয়েও আগামীতে সংসার চালানো কঠিন হবে। এসব খাতে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ কাজের যোগাড় করতে পারবে। চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বড় বিনিয়োগ। অথচ ডলার সংকটে শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানিই একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকারত্ব আরও বাড়বে।
তাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা বেকারত্বের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান চিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে আগের তিন মাসের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় বাংলাদেশে বেকার লোকের সংখ্যা বেড়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার। দেশে এখন মোট বেকারের মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ১০ হাজার এবং নারী আট লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের জরিপে ওই বছর দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার।
সরকারের নীতি-নির্ধারকরা এটিকে মৌসুমি বেকারত্ব বলে চালানোর চেষ্টা করলেও অর্থনীতিবিদরা এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডক্টর মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, এটা মৌসুমি বেকারত্ব নয়। সামনে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং বেকারত্ব আরও বাড়বে। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়ায় শিল্প উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে সেখানে শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। এটা তৈরি পোশাক খাতসহ সব শিল্প খাতেই হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। আর নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এখন অনেক সতর্ক। কারণ ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রফিট মার্জিন কমে গেছে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে ফলে তারাও কর্মী ছাঁটাই করছে। সব মিলিয়েই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
পঁচিশ হাজার টাকা বেতনে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা মনির হোসেন জানান, তার সংসারে টানাপোড়েন আগে থেকেই ছিল। এর ওপর নিত্যদিনের খাওয়া ও ব্যবহারের সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যে তিনি বাধ্য হয়ে বিকল্প আয়ের সন্ধানে নেমেছিলেন। তাই বিকাল ৫টা বাজতেই প্রতিদিন অফিস থেকে বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পার্টটাইম জব খুঁজতেন। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে মালিক পক্ষ তাকে চাকরিচু্যত করেছেন। এ পরিস্থিতিতে নিজের জমানো কিছু টাকা ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়েছেন। তবে গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় এ দোকানের আয়েও তার সংসার চলছে না। তাই দোকানে স্ত্রীকে বসিয়ে তিনি এখন গার্মেন্ট থেকে কিনে আনা স্টকলট অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা করছেন।
বারিধারা ডিওএইচএসের একটি বায়িং হাউজে হিসাব রক্ষক হিসেবে চাকরি করা লতিফুল ইসলাম জানান, চাকরির টাকায় তার তিনজনের সংসার আগে মোটামুটি ভালোভাবেই চলত। তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় কয়েক মাস আগে থেকেই সংসারে নতুন করে টানাটানি শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ছোট ভাই চাকরি হারিয়ে তার বাসায় আশ্রয় নেওয়ায় আর্থিক সংকট আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে তিনি বায়িং হাউজের মালিককে অনুরোধ করে তার কাছ থেকে কিছু ওয়েস্টেজ তৈরি পোশাক বাকিতে কিনে নিজের বাসায় এনে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছেন। ছোট ভাইয়ের হাতে এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এতেও তেমন লাভ না হওয়ায় এখন মাল ডেলিভারি দেওয়ার কাজেও তাকে লাগিয়েছেন।
সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জামাল হোসেন প্রতিদিন অফিস ছুটির পর দুই-তিন ঘণ্টা নিজের মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং করছেন। অফিসের সাপ্তাহিক ছুটির দিন পুরোটাই এ কাজে লাগাচ্ছেন। তবে এতেও খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় স্ত্রীকে স্থানীয় একটি ফ্যাশন হাউজে কাজ যোগাড় করে দিয়েছেন। তার সহকর্মীরা অনেকেই বিকল্প কাজের সন্ধানে ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু সুবিধামতো কাজ যোগাড় করতে অনেকে ব্যর্থ হচ্ছেন। পার্টটাইম কাজ না পেয়ে কেউ কেউ শিশু সন্তান কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের ছোটখাটো নানা পেশায় দিচ্ছেন।
একুশে সংবাদ/আ.জ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :