ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ১০ বছর আগে স্ত্রী মুক্তা বেগমকে নিয়ে ঢাকায় আসেন মো. মিজান হাওলাদার (৩০)। এসে ওঠেন রাজধানীর মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে। ঢাকায় এসে জীবিকার তাগিদে প্রথমে রিকশা চালাতেন। তবে এতে কষ্ট বেশি হওয়ায় পরে লেবুর শরবত বিক্রি শুরু করেন মিজান। সাত বছর আগে মিজান-মুক্তা দম্পতির ঘর আলোকিত করে আসে মেয়ে সন্তান লিমা আক্তার। ছয় মাস আগে জন্ম হয় ছেলে সন্তান হোসাইনের। কিন্তু এক অজানা ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় মিজান-মুক্তা দম্পতির তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন মিজান। ভারী বৃষ্টির কারণে সড়কে জমে যায় পানি। হাঁটু সমান পানি ঠেলেই এগোচ্ছিলেন তারা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে রাস্তায় মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা ও মেয়ে লিমা বিদ্যুতায়িত হন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তারা।
একই ঘটনায় আহত হয় মিজান-মুক্তা দম্পতির ছয় মাসের শিশু সন্তান হোসাইন। বলা যায় অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরে হোসাইন। বাবা-মা হারা শিশু সন্তানের এ পৃথিবীতে আপন বলে আর কেউ রইলো না। মিজানের পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন একই এলাকার এক তরুণ। মোহাম্মদ অনিক নামের ওই তরুণ অটোরিকশার চালক ছিলেন।
এরই মধ্যে এ ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে চার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে কর্তৃপক্ষ।
নিহতদের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত মিজান, তার স্ত্রী ও মেয়ে লিমার দাফন হবে ঝালকাঠিতে। এছাড়া অনিকের মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি গেছেন তার বাবা বাবুল মিয়া।
শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাতে কথা হয় মিজানের বাবা নাসির হাওলাদারের সঙ্গে। জাগো নিউজকে নাসির বলেন, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার সকালেই মিজান পরিবারসহ বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরেন। এরপর তিনি যান শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে থেকে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছিলেন। পথে বৃষ্টির কারণে জমে থাকা পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে স্ত্রী-কন্যাসহ মারা যান। তার শিশু সন্তান হোসাইন হাতে ও পিঠে আঘাত পেয়েছিল। সে এখন তার নানির কাছে আছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাসির বলেন, ‘বাপের কান্ধে পোলার লাশ দুনিয়ার সব থেইক্কা ভারী। আমার পোলার সাজানো-গোছানো সংসার, ঘরে আসবাবপত্রসহ সবকিছু পড়ে আছে। শুধু আমার পোলা-পোলার বউ আর নাতি লিমা নাই। ছয় মাসের নাতি হোসাইন কীভাবে বড় হবে বাপ-মা ছাড়া?’
মিজানের বাবা আরও বলেন, শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসাওপাতালের মর্গ থেকে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতির মরদেহ বুঝে পাই। পরে সেখান থেকে মরদেহ ঝিলপাড় বস্তিতে নেওয়া হয়। বস্তি থেকে মরদেহ নিয়ে মিরপুর ২ নম্বরে মসজিদ মার্কেটের ঢালে এনে গোসল করানো হয়। গোসল শেষে তাদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে তিনজনের দাফন হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিজান যখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন, তখন তার কাঁধে ছিল শিশু হোসাইন। শিশু সন্তান হোসাইনকে বাঁচানোর জন্য তাকে একদিকে ছুড়ে মারেন মিজান। এসময় পানিতে ভাসতে থাকা শিশু হোসাইনকে উদ্ধার করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান অনিক।
অনিকের মামাতো ভাই আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জাগো নিউজকে আনোয়ার হোসেন জানান, অনিক নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নের সাতগাঁও গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে। তারা ছয় ভাই ও দুই বোন। অনিক ভাইদের মধ্যে ষষ্ঠ। মিরপুর এলাকায় অটোরিকশা চালাতেন তিনি।
অনিকের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তার মামাতো-ফুপাতো ভাইসহ আরও কয়েকজন স্বজন। তারা জানান, পড়াশোনা ছেড়ে ছয়-সাত বছর আগে ঢাকায় আসেন অনিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করেছেন। দুই বছর আগে বিয়ে করেন। কিন্তু সম্প্রতি স্ত্রীর সঙ্গে অনিকের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। কিছুদিন আগে অনিকের স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। শুক্রবার বাড়ি ফেরার কথা ছিল অনিকের। বাড়ি ঠিকই ফিরছেন, তবে লাশ হয়ে।
একুশে সংবাদ/আ.জ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :