- বেড়েছে বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক, প্ল্যাস্টিক পণ্য ও চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি
- বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের ৮৪.৫৭ ভাগই এসেছে পোশাক খাত থেকে
- এক বছরের ব্যবধানে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ
- রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য, রপ্তানি বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ইতিহাস লম্বা। ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ তখন বিধ্বস্ত। এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের স্বপ্ন দেখেন এক অদ্যম ব্যক্তি-তার নাম রিয়াজ উদ্দিন। পুরান ঢাকার উর্দু রোডের বাসিন্দা। তিনিই রিয়াজ স্টোর নাম দিয়ে রেডিমেট শার্ট তৈরি শুরু করেন। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতি পিস শার্টের দাম তখনকার বাজারে ছিল ১০০ টাকা। ‘মেডিন বাংলাদেশ’ স্লোগানকে ধারণ করে রিয়াজ উদ্দিন স্বপ্ন দেখেন বিদেশে রপ্তানির। সময়টা ১৯৭৮ সালের ২৮ জুলাই।
ফরাসি ক্রেতা হলান্ডার ফ্রঁসের কাছে ১০ হাজার শার্ট রপ্তানী করেন রিয়াজ উদ্দীন। ফরাসী মুদ্রায় দাম ছিল ১৩ মিলিয়ন ফ্রা, বাংলাদেশী টাকায় ৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। মেডিন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের শার্ট রপ্তানি করে প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ব্যক্তির রিয়াজ উদ্দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকও তিনি। এরপর নুরুল কাদের নামের আরও উদ্যোক্তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশ গার্মেন্ট। পরবর্তীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সড়কে সামিল হলেন আনিসুর রহমান সিংহা। সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত শিল্পটির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় চালকের ভূমিকায় ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন ও এম নুরুল কাদের। তৈরি পোশাক রফতানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে পথকে মসৃণ করতে তিনজনের কৃতত্ব স্মারক হয়ে থাকবে।
ইপিবির তথ্য বলছে, বিদায়ি অর্থবছরে তৈরি পোশাক, প্ল্যাস্টিক পণ্য ও চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বেড়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমেছে। রপ্তানি আয় ধরে রেখেছে মূলত তৈরি পোশাক। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পোশাক খাতের রয়েছে মাথা উঁচু অর্জন। বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের ৮৪.৫৭ ভাগই এসেছে পোশাক খাত থেকে। এক বছরের ব্যবধানে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি কম হয়েছে ৪.২১ শতাংশ। কিন্তু রপ্তানি বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ। বিদায়ী অর্থ বছরের রপ্তানির পরিমাণ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিলো ৫ হাজার ২২৮ কোটি টাকার পণ্য। তার আগের বছরের তুলনায় ৩৪.৩৮ শতাংশ বেশি।
সবশেষ গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাক খাতে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ ছিল মোট রপ্তানির প্রায় ৭১ শতাংশ। গত বছরের একই প্রান্তিকে এ খাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল মোট রপ্তানির সাড়ে ৫১ শতাংশ। এই হিসাবে প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানা গেছে। যদিও পোশাক খাতের প্রকৃত আয়ের এ হিসাব নিয়ে পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের সন্দেহ বা প্রশ্ন রয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে অধিকাংশ কারখানা ২০-৩০ শতাংশ কম উৎপাদন সক্ষমতায় চলেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে উৎপাদনও কম-বেশি ব্যাহত হয়েছে। তাই এ খাতের প্রকৃত আয়ের তথ্য নিয়ে তারা সন্দিহান।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, ফলে ক্রেতারা প্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্য কেনা কমিয়ে দেন। তাতে কমে যায় পোশাক বিক্রিও। পোশাক খাতের রপ্তানি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ গত ৩০ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পোশাক খাতের প্রকৃত রপ্তানি বা মূল্য সংযোজন ছিল ৮২২ কোটি মার্কিন ডলারের। পোশাকের মোট রপ্তানি আয় থেকে কাঁচামাল আমদানি বাবদ খরচ বাদ দিয়ে প্রকৃত আয়ের এ হিসাব করা হয়েছে।
নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, পোশাকের মূল্য সংযোজন অস্বাভাবিক। কারণ, হঠাৎ এ খাতে এত মূল্য সংযোজনের যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছেন না তিনি। বরং আগের তুলনায় এখন কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে।
অনেকে প্রকৃত রপ্তানি আয়কে পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। যদিও অর্থনীতিবিদরা এটিকে মূল্য সংযোজন হিসেবে মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, পোশাক শিল্পে নির্দিষ্ট একটি সময়ে যে পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করা হয়, সেগুলো রপ্তানির ক্ষেত্রে এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের রপ্তানি আয় থেকে আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত যে আয় পাওয়া যাবে, সেটিকে প্রকৃত মূল্য সংযোজন বলা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি বাবদ মোট আয় ছিল ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৩৯ কোটি ডলার। তাতে এ খাতের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৮২২ কোটি ডলারে, যা এ খাতের মোট আয়ের প্রায় ৭১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ হাজার ২৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি বাবদ ব্যয় ছিল ৪৯৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ খাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল ৫২৯ কোটি ডলার, যা মোট আয়ের সাড়ে ৫১ শতাংশ।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে পোশাক খাতের প্রকৃত রপ্তানি হঠাৎ করে বেড়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের ৭১ শতাংশই ছিল প্রকৃত আয়। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা বেড়ে হয় সাড়ে ৭১ শতাংশ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, পোশাক খাতের রপ্তানির বিপরীতে আমদানির যে তথ্য, তাতে আমদানি খরচ অনেক কমেছে। কয়েকটি কারণে এটি হতে পারে, প্রথমত পণ্যের চাহিদা কম থাকায় আমদানিও কমতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে পোশাকের কাঁচামালের দাম কিছুটা কমেছে, তাই এ বাবদ খরচ কমে গেছে। তৃতীয় কারণ হতে পারে, ডলার-সংকটের কারণে আমদানি কম হয়েছে। ওভেন পোশাকের চেয়ে নিট পোশাকে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বেশি। ওভেন পোশাক রপ্তানি করে যে আয় হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। আর নিট পোশাকের ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের ১৫ শতাংশের মতো খরচ হয় কাঁচামাল আমদানিতে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে ওভেনের তুলনায় নিট পোশাক রপ্তানিতে ভাল করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতের এক হাজার ১৬২ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭৬ কোটি ডলার। আর একই সময়ে ওভেন পোশাকের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৮৫ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় সাড়ে ৪৯ শতাংশই ছিল নিট পোশাকের, আর ওভেনের সাড়ে ৩৫ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরেও নিট এবং ওভেন পোশাকের রপ্তানি ছিল প্রায় সমান সমান। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ওভেনকে ছাড়িয়ে যায় নিট পোশাকের রপ্তানি। এরপর প্রতি অর্থবছরই নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২২–২৩ অর্থবছরে পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের প্রায় সাড়ে ৪৬ শতাংশ ছিল নিট খাতের আর ওভেন খাতের ছিল সোয়া ৩৮ শতাংশ।
একুশে সংবাদ/এএইচবি/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :