নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর বাড়তি মূল্যের চাপে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধকল্পে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারি সংস্থা গুলির সমন্বয়হীনতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যার্থ হচ্ছে সব আয়োজন। কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে থাকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। সে ক্ষমতাবলে সম্প্রতি মাছ-মাংস, খেজুর, বিভিন্ন সবজিসহ মোট ২৯টি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকারের এ সংস্থা। মূল্য নির্ধারণের ৯ দিন পার হয়ে গেলেও এর প্রভাব পড়েনি বাজারে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নির্ধারিত সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য গরুর মাংস ৬৬৪.৩৯ টাকা, বাজার মূল্য ৭৮০-৮০০ টাকা, মসুর ডাল ১০৫.৫ টাকা, বাজারে মূল্য ১২০-১৩০টাকা, অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর নির্ধারিত মূল্যের বাজার মূল্যের চিত্র এমন ছোলা ৯৮.৩০ বাজারে ১১০-১২০, আলু ২৮.৫৫ বাজারে ৫০-৬০, পেয়াজ ৬৫.৪০ বাজারে ৮০-৯০, ব্রয়লার মুরগী ১৭৫.৩০ বাজারে ২৩০-২৪০, ডিম পিস ১০.৪৯ বাজারে ১১, বেগুন ৪৯.৭৫ বাজারে ৬০-৯০, কাঁচামরিচ ৬০.২০ বাজারে ৮০-১০০, টমেটো ৪০.২০ বাজারে ৬০ -৮০, শিম ৪৮ বাজারে ৫৫-৭০, পাঙ্গাশ মাছ ১৮০.৮৭ বাজারে ২২০-২৪০, চিড়া ৬০ বাজারে ৭০-৮০, রসুন ১২০ বাজারে ১৬০-১৭০, রসুন, কাতলা মাছ, সোনালী মুরগী, খেজুর (জাইদি), চাল সহ অন্যান্য পণ্যের বেলাতেও একই চিত্র দেখা যায়। বাজারে অস্থিরতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যারা অধিক মুনাফা করছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পাড়া মহল্লায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি শুরু হলে অধিক মুনাফা রোধ করা যাবে।
এবিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, চাঁদাবাজির কারণে যাতে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে সে জন্যে চাঁদাবাজি রোধে পুলিশ -র্যাব কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারে যে জিনিস ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অল্প দুরে ফার্মগেট কিংবা অন্য জায়গায় নিয়ে ৪০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এমন অধিকার মুনাফার চিন্তা থেকেই সাধারণ ভুক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়ে। তিনি আরও বলেন, চাঁদাবাজির চাইতে অধিক মুনাফার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে রাজধানীতে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি রোধে পুলিশের স্পেশাল ড্রাইভ চলছে। অপরদিকে নির্ধারিত মূল্য কার্যকর না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের যৌক্তিক মূল্য তালিকা কেউ না মানলে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা নেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, তদারকির মাধ্যমে তারা কেবল অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তখন দ্বারস্থ হতে হয় প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের। সংস্থাটি থেকে তাই বিভিন্ন সময় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে বিভিন্ন সময় দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও বাস্তবায়নকারী বা তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে তা আর বাস্তবায়ন হয় না। এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বাজারসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একই ছাতার নিচে এনে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন তারা। এবিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন বলেন, আমাদের দেশে বাজার তদারকির ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান সমন্বয় নেই। যদিও মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসন সমন্বয় করার কথা ছিল। কিন্তু তা আমরা দেখছি না। সমন্বয় না থাকলে কোনো কাজেই ফল আসে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। এতে কাউকে জরিমানা করলে তার ফলোআপ কেউ করছে না। আইনের প্রয়োগও যথাযথ হচ্ছে না। কারণ আইনে বলা হয়েছে, একই ব্যক্তি একাধিকবার অপরাধ করলে তার শাস্তিও বেশি হবে। সমন্বয়হীনতা এখন বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত শুক্রবার ২৯টি পণ্যের উৎপাদন খরচ, উৎপাদক পর্যায়ে সর্বোচ্চ দাম, পাইকারি বাজারে ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা দাম কত হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। যদিও নির্ধারিত এ দামে বাজারে পণ্য পাচ্ছেন না ক্রেতারা। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই বড় ধরনের অসামঞ্জস্য।
পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে তার প্রতিফলন না থাকার বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলেন, আমরা যে আইনের ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি বাজারে তার ব্যত্যয় ঘটলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। কেননা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর শাস্তি দিতে পারে না। আমরা শুধু অভিযোগ দিতে পারি। তার প্রমাণাদির ভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট শাস্তি দেন। মোবাইল কোর্টে মামলা করার যে পদ্ধতি তার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত আকারে অভিযোগ দেয়া হয় এবং তারপর দুই পক্ষের কথা শুনে বিচার করা হয়।
কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-এর ৪ (ঝ) ধারায় বলা হয়েছে, সংস্থাটি কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করতে পারবে। এ আইন বাস্তবায়নে বাধা দূর করতে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। যদিও আইন অনুযায়ী কাউকে শাস্তি দিতে হলে প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে যাই থাকুক, কোনো প্রথম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ আইনের অধীন দণ্ড আরোপ করতে পারবেন।
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা জনবল সংকট। সারা দেশে সব মিলিয়ে ৫০০-এর মতো জনবল রয়েছে। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে পারেন প্রতি জেলায় এমন আছেন কেবল দুই-তিনজন করে। আইনি সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। তাই আমাদের অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতা নেই। আমরা এর আগে এ বিষয়ে আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু জনবল কাঠামো অনুসারে তা দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা আছেন হাতে গোনা কয়েকজন।
জানা গেছে, মাঠ পর্যায় থেকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ২৯টি পণ্যের উৎপাদন খরচ ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মীরা নির্ধারিত ফর্মুলা অনুযায়ী এ তথ্য সংগ্রহ করেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য সরকারি সংস্থারও সহায়তা নেয়া হয়েছে।এটা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব এজেন্সিরই দায়িত্ব রয়েছে।
ডিম, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়ার পর গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা অভিযান চালিয়েও ওই দাম কার্যকর করতে পারেনি। রোজার আগে ভোজ্যতেল, চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেঁধে দেয় সরকার। এরপর দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজার, পরিশোধন কিংবা মোড়কজাতকারী মিলগুলোয় অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকারসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি কিংবা মজুদ বেশি রাখায় জরিমানাও করা হয়। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে এলে বাজারে এর প্রভাব কমে আসে। রোজা শুরুর পর থেকে ফের বাড়তে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যের দাম।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে চাহিদার সঙ্গে জোগানের অসামঞ্জস্য, উৎসমুখ থেকে বাড়তি দামে পণ্য কেনার কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তাদের দাবি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। মোকাম থেকে বাড়তি মূল্যে কেনার কারণে চাইলেও সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না।
বাজার সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, বাজার তার নিজস্ব গতিতেই চলে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী খুচরা পর্যায়ে বাড়তি মূল্যে পণ্য বিক্রির চেষ্টা করে। কিন্তু একটা দেশে সার্বিকভাবে যদি পণ্যের দাম বেড়ে যায় তবে বুঝতে হবে উৎপাদন, আমদানি কিংবা সরবরাহ চ্যানেলে কোনো সংকট রয়েছে। প্রশাসন বাজার নিয়ন্ত্রণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরও অনেকগুলো পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি, ডলার ও এলসি সংকটে আমদানি প্রক্রিয়ায় সংকটের কারণে বাজারের ঊর্ধ্বমুখিতাকে নিম্নমুখী করা সম্ভব হচ্ছে না।’
সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বাজারে নির্ধারিত দামে পণ্য পাওয়া যায় না বলে মনে করেন একজন সাবেক সচিব। তিনি বলেন, দাম নির্ধারণ করে দেয়া অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এসব বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। সরকারের তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। ফলে এসব উদ্যোগ ভালো হলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। আগে তদারকি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বড় বড় উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হবে না।
সরকারের ১১টি সংস্থা মূলত পণ্যের বাজার মনিটরিং করে। সেগুলো হলো ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি,বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে কিংবা রোজার সময় সংস্থাগুলো যে যার মতো উদ্যোগ নেয়। তবে বিচ্ছিন্ন এ কাজে বাজারে তেমন প্রভাব পড়ে না
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :