পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে নাড়ীর টানে নীড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকাসহ দেশের পেশাজীবী মানুষ। পরিবার কিংবা আত্নীয়—পরিজনের সাথে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে কর্মস্থল ছেড়ে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টিকিট কারসাজি ও কালোবাজারিসহ সকল ধরনের পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয় ব্যাপকহারে। যে কারণে ঘর ও কর্মস্থলে ফেরা মানুষেরা আতঙ্কিত থাকে। এবার ঈদের আগে তেলের দাম কমানোতে পরিবহনের ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত হয় গতকাল।
জানা যায়, এবার দূরপাল্লার পরিবহন, ট্রেন এবং বিমানের অগ্রীম টিকিট বিক্রি শুরু হয় ঈদের ১৫ দিন আগে থেকেই। অগ্রীম টিকিটে ভাড়া বাড়ানো না হলেও নানা কারসাজির খবর দিয়েছে ভুক্তভোগী মানুষেরা। অনলাইনে বিক্রি হওয়া টিকিট জালিয়াতির দায়ে সম্প্রতি কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শেষ হয়েছে ৩০ মার্চ। বড় পরিবহন কোম্পানির বাসের টিকিটও ৮০ শতাংশ বিক্রি হয়ে গেছে। বড় কোম্পানির টিকিট কাউন্টারের সামনে ভাড়া না বাড়ানোর ব্যানার টানানো থাকলেও কারসাজি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে টিকিট ক্রেতাদের কাছ থেকে। যাত্রীদেরকে মধ্য পথের টিকিট নেই বলে অতিরিক্ত যাত্রাপথের টিকিট দিয়ে দ্বিগুণ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাহমুদ নামে একজন যাত্রী মোহাম্মদপুরের শ্যামলী কাউন্টারে টিকিট কাটতে যায়। সেখানে দিনাজপুরের টিকিট কাটতে চাইলে কাউন্টার মাস্টার বলে দিনাজপুরের টিকিট দেয়া যাবে না। অগ্রীম টিকিট নিতে হলে আপনাকে পঞ্চগড়ের টিকিট কাটতে হবে। ভুক্তভোগী যাত্রী মাহমুদ জানান, দিনাজপুরের টিকিটের মূল্য ৯৫০ টাকা। পঞ্চগড়ের টিকিট কাটতে হলে আমাকে ৫থেকে ৬ শত টাকা বেশি দিতে হবে। অথচ আমি দিনাজপুর নেমে যাওয়ার পর তারা সেখান থেকে আবারও যাত্রী তুলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করবে। একইভাবে কারসাজি করে প্রায় সব বড় কোম্পানি গুলি বিভিন্ন মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের টিকিটে গন্তব্যের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
দেশের বিমান সংস্থাগুলোরও অধিকাংশ টিকিট বিক্রি শেষ, ফলে বাকি যেসব টিকিট এখনো অবিক্রিত, সেগুলোর নাগাল পেতে মূল্য দিতে হচ্ছে দুই থেকে তিন গুণ বেশি। ট্রেনের টিকিট কাউন্টার কিংবা সংশ্লিষ্টদের কাছে পাওয়া না গেলেও চড়াদামে কালোবাজারিদের কাছে মিলছে টিকিটের সন্ধান। অনলাইনে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কম ও রেলওয়ের অসাধু কিছু কর্মকর্তা—কর্মচারী কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
এবার ঈদযাত্রার টিকিট বিক্রি শুরুর আগে রেলওয়ের কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন ওটিপি পাঠানোর এ পদ্ধতি নতুন চালু হওয়ায় টিকিট নিয়ে কারসাজি অনেকটা কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা কমেনি।
যাত্রীদের অভিযোগ টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার পর মুহূর্তেই টিকিট শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবার অনলাইনে আসন ফাঁকা দেখালেও টিকিট কিনতে গেলে সেটি বিক্রি দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সহজ ডট কমের প্রযুক্তিগত জালিয়াতির পাশাপাশি নানা কৌশলে কালোবাজারি চক্র বিভিন্ন রুটের টিকিট আগে থেকেই সংগ্রহ করে রাখছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
এবার ঈদে আগাম টিকিট বিক্রি শুরুর আগে রেলপথমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, টিকিট বিক্রির কালোবাজারি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে এবার যাত্রীদের টিকিট নিয়ে ভোগান্তি বন্ধ হবে। তিনি বলেছিলেন, টিকিট বিক্রি শুরুর পর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সার্ভার ডাউনের কারণে সাইটে প্রবেশ করা যায় না। এসব অভিযোগ মিথ্যা নয়। টিকিট কালোবাজারির সাথে একটি সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। যাদের সাথে রেল ও সহজের লোকজন জড়িত। রেলমন্ত্রী বলেন, আমরা দুটি সিন্ডিকেটকে ধরে আইনের আওতায় এনেছি। ঠিকমতো টিকেটিং ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য সহজকে সতর্ক বার্তাসহ কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিকিট কালোবাজারি বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রেলের কর্মকর্তা—কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না।
ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির অভিযোগে সম্প্রতি সহজ ডট কমের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২২৪টি টিকিট জব্দ করা হয়। তারা প্রতিদিন কালোবাজারির মাধ্যমে পাঁচ শতাধিক টিকিট সংগ্রহ করে বেশি দামে বিক্রি করত। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা রেলস্টেশনে কর্মরত অসাধু কর্মচারী, সহজ ডটকমের অসাধু কর্মকর্তা এবং সার্ভার রুম ও আইটি শাখার কর্মীদের সহযোগিতায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করত বলে জানিয়েছে র্যাব।
অন্যদিকে বাড়িতে যাওয়ার পাশাপাশি ঢাকায় ফেরার টিকিটও কাটছেন অনেকে। ট্রেনের ফিরতি যাত্রার অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হবে ৩ এপ্রিল। উড়োজাহাজের ফিরতি ফ্লাইটের অধিকাংশ টিকিটও বিক্রি হয়ে গেছে।
ঈদুল ফিতরের ছুটিতে কেউ উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে সৈয়দপুরে যেতে চাইলে কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হবে। ঈদের আগে ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিলে এই ভাড়া দাঁড়াবে সাড়ে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত। এই পথে চলাচলকারী উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর ঈদযাত্রার অধিকাংশ ফ্লাইটের ৮০ শতাংশের বেশি টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
দেশের কয়েকটি বিমান সংস্থার সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২৫ রোজার পর থেকে টিকিটের চাহিদা বেশি। ইতিমধ্যে অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় বাকি টিকিটের ক্ষেত্রে সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি দাম পড়ছে। চাহিদা বেশি থাকায় সৈয়দপুর ও রাজশাহীর টিকিটের দাম তুলনামূলক বেশি। টিকিটের চাহিদা থাকায় অভ্যন্তরীণ রুটে অতিরিক্ত ৯টি, যাওয়া—আসা মিলে ১৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ৪ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সৈয়দপুর, রাজশাহী, যশোর ও বরিশাল রুটে এসব ফ্লাইট পরিচালিত হবে। এ ছাড়া সিলেট ও চট্টগ্রাম রুটের বিমানের বড় আকারের উড়োজাহাজ থাকায় অতিরিক্ত ফ্লাইট দেওয়া হয়নি।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক জনসংযোগ তাহেরা খন্দকার কালের সমাজকে জানিয়েছেন, ঈদের আগে বিমানের ফ্লাইটগুলোর ৮০ শতাংশ টিকিট ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। সৈয়দপুর ও রাজশাহী পথে টিকিটের চাহিদা বেশি থাকায় অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান। ঈদের পর বিমানের ফিরতি ফ্লাইটের অধিকাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছে।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :