সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মেট্রোরেল রাজধানীর নাগরিক জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। অসহনীয় যানজটের ধকল কাটিয়ে মানুষজন এখন উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পৌছায় মাত্র ৩৩ মিনিটে। নগর জীবনের গতি ফিরিয়ে দিয়েছে মেট্রোরেল। পরিবেশ সহায়ক মেট্রোরেল বাযু দুষণ রোধে রাখছে বিশাল ভূমিকা। মেট্রোরেল সম্পূর্ণ বিদুৎ চালিত বিধায় জীবাশ্ম তরল জ্বালানী ব্যবহার হচ্ছে না। নগর জীবনের স্বস্তির বাহন এই গণপরিহনে যুক্ত হচ্ছে ভ্যাট। এতে ভাড়া বাড়তে পারে ৩ থেকে ১৫ টাকা। মেট্রোরেলের সময় সূচিও বদলে যাবে সহসাই। বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত এই প্রকল্প সম্প্রসারিত হচ্ছে ঢাকার পাশের বিভিন্ন এলাকায়।
মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট মওকুফ চায় এর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। এ জন্য নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে সংস্থাটি। চেষ্টা চলছে যেন টিকিটের ওপর ভ্যাট না বসানো হয়। ৪ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আগামী জুলাই থেকে মেট্রোরেলের টিকিটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কথা মেট্রোরেল কোম্পানিকে জানিয়ে দেয়। মেট্রোরেল চালুর পর আগামী জুন মাস পর্যন্ত ভ্যাট মওকুফ করেছিল এনবিআর।
তবে ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্তের পর নড়েচড়ে বসে মেট্রোরেল কোম্পানি। এনবিআরের সিদ্ধান্তের কথা সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে অবহিত করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। সংশিষ্ট সূত্র জানায়, ভ্যাট না বসানোর বিষয়ে শিগগিরই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। অন্যদিকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এনবিআরের সঙ্গেও বৈঠক করতে চায়। চলতি মাসেই এ নিয়ে বৈঠক হতে পারে বলে জানা গেছে। এর আগেও একাধিক বৈঠকে ভ্যাট না বসানোর যৌক্তিকতা বোঝানো হয়েছে।
ভ্যাট আইন অনুসারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেল টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর বিধান আছে। কিন্তু সাধারণ ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শ্রেণি ছাড়াও অন্যান্য শ্রেণিও আছে। যাত্রীদের টিকিটের ‘শ্রেণি’ পছন্দ করার সুযোগ আছে। কিন্তু মেট্রোরেলে পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানে সব যাত্রীকে একই টিকিট কিনতে হয়। এ ছাড়া মেট্রোরেল এখন পুরোপুরি গণপরিবহন, যাতে সাধারণ জনগণ ভ্রমণ করেন। ভ্যাট বসানো হলে যাত্রীদের উপর চাপ সৃষ্টি হবে। সংশিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ভ্যাট না বসানোর বিষয়ে সরকারের সংস্থা এনবিআর ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সমঝোতা না হলে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে হস্তক্ষেপ কামনা করা হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা অবশ্য জানান, এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায়ের বিরাট চাপ আছে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করতে হবে। এসব কারণেই মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট মওকুফের সময় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চালুর পর থেকে মেট্রোরেল সেবার ওপর ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। গত বছর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলছে মেট্রোরেল। বর্তমানে প্রতিদিন কমবেশি আড়াই লাখ যাত্রী পরিবহন করে এই নগর পরিবহনব্যবস্থা। চালুর পর এ পর্যন্ত মোট প্রায় ৮ কোটি যাত্রী মেট্রোরেলে ভ্রমণ করেছেন। এ পর্যন্ত সাড়ে চার লাখের মতো ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট পাস বিক্রি হয়েছে। অর্ধেকের বেশি যাত্রী এখন এই পাস ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে। অপরদিক রাজস্ব আদায়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট মওকুফ অব্যাহতি দেবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। তবে মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট মওকুফ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে। চলছে যুক্তি পাল্টা যুক্তি।
জনস্বার্থে মেট্রোরেলের টিকিটে ভ্যাট আরোপ না করার আহ্বান জানিয়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেল টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর বিধান আছে। কিন্তু মেট্রোরেল একটি গণপরিবহণ। ভ্যাট বসানো হলে যাত্রীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। দুই সংস্থায় দেওয়া চিঠিতে ডিএমটিসিএল বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা, পদ্ধতি এবং বাংলাদেশের জলবায়ু ও অর্থনীতিতে মেট্রোরেলের অবদান তুলে ধরে।
এতে বলা হয়েছে, মেট্রোরেলের আংশিক বাণিজ্যিক পরিচালনা শুরুর পর বিদ্যুতের দাম ২০২৩ সালে ৩ বার এবং ২০২৪ সালে এক বার বাড়ানোর হয়েছে। তার ওপর ক্লিয়ারিং হাউজ সার্ভিস ফি বাবদ এমআরটি পাশ ব্যবহারের ওপর ৩ শতাংশ টাকা ঢাকা পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়। কিন্তু জনসাধারণের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের ভাড়া বাড়ায়নি। অথচ ডিএমটিসিএল বা সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এনবিআর মেট্রোরেলের টিকিটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাতিল করে। এখন সেই ভ্যাটের বোঝা সেবা গ্রহণকারী হিসাবে মেট্রোরেলের যাত্রীদের ওপর বর্তাবে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের জন্য মেট্রোরেল একটি নতুন শিল্প। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সব ধরনের নতুন শিল্পকে দীর্ঘমেয়াদি কর রেয়াত সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মেট্রোরেল প্রায় ২৫ বছর ধরে চলছে। একই সঙ্গে সম্প্রসারণ কাজ অব্যাহত থাকায় মেট্রোরেল সেবার ওপর কোনো ভ্যাট নেই। ঢাকাতেও মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ চলছে।
এছাড়া কোথাও শুধু ভাড়ার আয় থেকে লাভজনকভাবে মেট্রোরেল চলে না। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো ভাড়া থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ আয় করে থাকে, অবশিষ্ট ৩৫ শতাংশ আয় কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় সরকার ভর্তুকি হিসাবে দিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বার্লিন মেট্রোরেল ভাড়া থেকে ৪৩ শতাংশ আয় হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ স্থানীয় ও আঞ্চলিক সরকার ভর্তুকি হিসাবে দিয়ে থাকে। আমস্টারডাম মেট্রোরেল ভাড়া থেকে ৪১ শতাংশ আয় করে, অবশিষ্ট ৫৯ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ভর্তুকি হিসাবে দিয়ে থাকে।
সহসাই মেট্রোরেলের সময়সূচি পাল্টাবে:
চলাচলের সময় কয়েক ধাপ বাড়ার সঙ্গে মেট্রোরেলে বেড়েছে যাত্রীর সংখ্যাও। বর্তমানে রাজধানীর উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সবগুলো স্টেশনে রাত পর্যন্ত যাত্রী উঠানামা করছে। সর্বশেষ, ১৬ রমজান থেকে মেট্রোরেল চলাচলের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয। এতে মতিঝিল থেকে সর্বশেষ ট্রেন ৮টা ৪০ মিনিটের পরিবর্তে ৯টা ৪০ মিনিটে এবং উত্তরা উত্তর থেকে সর্বশেষ ট্রেন ৮টার পরিবর্তে ৯টায় ছেড়ে যাচ্ছে। তখন বলা হয়েছিল ঈদ পর্যন্ত এই সূচি বহাল থাকবে। মেট্রোরেল সূত্র জানায়, বাড়ানো সময়ে ঈদের আগে যাত্রী বেড়েছিল। এখনো ঈদের আমেজ থাকায় আরও কিছু সময় যাত্রী সংখ্যা দেখে তার পর নতুন সময় সূচি নির্ধারণ করবে তারা। এক্ষেত্রে চলাচলের সময় বাড়তেও পারে আবার কমতেও পারে। এই সময়ে আগের মতো বাড়তি এক ঘণ্টা মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে হলে যাত্রীদের নিজস্ব পাস থাকতে হবে। তখন একক যাত্রার টিকিট বিক্রি হবে না।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, রমজানের আগের ১৫ দিনের হিসাবে দৈনিক গড়ে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজারের বেশি যাত্রী মেট্রোরেল ব্যবহার করেছেন। রোজার শুরুতে যাত্রী চলাচল কমে দেড় লাখে নেমে আসে। জানা গেছে, রমজানের মাঝামাঝি মেট্রোরেলের চলাচল এক ঘণ্টা বাড়ানোর পর যাত্রীর সংখ্যা আবারও কিছুটা বেড়েছে। বর্তমান সময় সূচি অনুযায়ী দৈনিক ৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৭২ জন যাত্রী মেট্রোরেলে ভ্রমন করতে পারবেন। তবে আপাতত ৫ লাখ যাত্রী বহনের লক্ষ্য ডিএমটিসিএলের। উত্তরা উত্তর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে ৬ লাখের ওপরে যাত্রী বহন করা যাবে বলে জানা যায়।
যেভাবে শুরু কর্মপরিকল্পনা:
ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ৬টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড, ডিএমটিসিএল-এর আওতায় একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার নিমিত্ত সরকার সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৩০ গ্রহণ করেছে। এই কর্মপরিকল্পনা অনুসরণে উত্তরা উত্তর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৭টি স্টেশন বিশিষ্ট বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি লাইন-৬ এর নির্মাণ কাজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ঢাকা মেট্রোরেলের প্রথম রেলপথ এমআরটি লাইন-৬। বাংলাদেশের প্রথম এ দ্রুতগামী গণপরিবহন রেলপথ ২০২২ সাল থেকে সেবা প্রদান করে আসছে। সম্পূর্ণরূপে উড়াল রেলপথ উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ‘১৬টি স্টেশন বর্তমানে চালু রয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকপ্লের যাত্রা:
২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে ঢাকায় একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য সুপারিশ করে। একই বছরে মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লুই বার্জার গ্রুপ ঢাকার জন্য একটি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। বিশ্ব ব্যাংক এই খসড়া পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করলেও প্রথমে কোন দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার সুপারিশ ছিল না।
নির্মাণ প্রকৌশলী ও জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী এই পরিকল্পনা পর্যালোচনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে পর্যালোচনা দল পরিকল্পনায় দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার তিন বছর পরে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা মেট্রোরেল প্রকল্পে যোগ দেয়। শহুরে পরিবহন গঠন গবেষণায় জাইকা প্রস্তাবিত রেলপথগুলোর মধ্যে এমআরটি লাইন ৬-কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক হিসেবে বিবেচনা করেছিলো। ২০১০–২০১১ অর্থবছরে এই লাইন নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালনো হয়।
২০১১ সালে রেলপথের জন্য একটি খসড়া যাত্রাপথের মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়। মানচিত্র অনুযায়ী রেলপথটি উত্তরা থেকে সায়দাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিলো। প্রস্তাবিত বিজয় সরণি স্টেশন বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের সামনে নির্মিত হওয়ার কথা ছিলো, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে স্টেশনটি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়। খসড়া যাত্রাপথে যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতু এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের অনুরোধে প্রস্তাবিত যাত্রাপথ উড়ালসেতু থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিলো। খসড়া যাত্রাপথে মেট্রোরেল মিরপুর সেনানিবাসের উপর দিয়ে দেখানো হয়েছিল; তবে সেনাবাহিনী সেখানে একটি আবাসিক এলাকা নির্মাণ করতে চাওয়ায় রেলপথটির অবস্থান এর থেকে পূর্বে সরিয়ে নেয়া হয়। রেলপথ তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা অতিক্রম করার কথা ছিলো, পরে জাতীয় সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রধানন্ত্রীকে পরিকল্পনা পর্যালোচনা কমিটি রেলপথের গন্তব্যস্থল সায়দাবাদের বদলে মতিঝিল করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এছাড়াও যাত্রাপথটি বাংলামোটরের মধ্য দিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে যাত্রাপথ মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনে বর্তমান মানচিত্র হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়।
জাইকা উত্তরায় প্রস্তাবিত তিনটি স্টেশন ভূমিতে এবং বাকি স্টেশনগুলো মাটির নিচে বানাতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভারতীয় গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ইলাত্তুভালাপে শ্রীধরন সমগ্র রেলপথ মাটি থেকে উঁচুতে নির্মাণ করার পরামর্শ দেন। কেননা তার মতে ভূগর্ভস্থ রেলপথে নির্মাণ ও দেখাশোনায় অনেক খরচ হবে।এই পরামর্শের ফলে পুরো রেলপথ মাটি থেকে উঁচুতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বরে এমআরটি লাইন ৬ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং পরবর্তী বছরে জাইকা নির্মাণ প্রকল্পের জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে এবং এর পরিচালক সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১৪ সালে প্রকল্প কর্মকর্তাগণ রেলপথ স্টেশনের নকশা প্রস্তুত করে। একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার দুই বছর পর এর ধারণাগত নকশা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে সংশোধিত এসটিপির চূড়ান্ত সংস্করণে এই রেলপথসহ ঢাকায় মোট পাঁচটি দ্রুতগামী গণপরিবহন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। লাইনটি নির্মাণের আগে উত্তরা-মিরপুর অংশে তিনটি বাধার সন্মুখিন হয়। প্রথম বাধা উত্তরা থেকে মিরপুর পর্যন্ত স্থানীয় সড়কের সংকীর্ণতা।দ্বিতীয় বাধা উত্তরা ও মিরপুরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত একটি হৃদ। তৃতীয়টি ছিলো প্রস্তাবিত যাত্রাপথে থাকা শ্রী শ্রী গৌড় নিতাই মন্দির। এসব বাঁধা অতিক্রম করতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সড়কটি প্রশস্ত করে দেয়। হ্রদের চিহ্নিত জায়গাগুলো ভরাট করে জায়গাগুলোতে পাইলিংয়ের কাজ শেষ করা হয়। মন্দির কর্তৃপক্ষ মন্দির স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়।
লাইনের যাত্রাপথটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে এর অবস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে নেয়া হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৭ জানুয়ারি ২০১৬ সাল থেকে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি মেট্রো স্টেশন নির্মাণের উপকারিতা তুলে ধরার পর তারা বিরোধিতা করা থেকে সরে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের হাসপাতালের সামনে দিয়ে রেলপথ নেয়ার সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছিলো। তবে হাসপাতালের নিকটে একটি স্টেশন করা হলে রোগীরা উপকৃত হবে এমন আশ্বাস ডিটিসিএ দেয়ার পরে কর্তৃপক্ষ সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
মেট্রোরেল নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়:
২০১৬ সালের ২৬ জুনে এর নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। রেলপথ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবানের সময় গুলশান হামলার ঘটনা ঘটে, ফলে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করায় কিছু কোম্পানি দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে চলে যায়। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ৭জন জাপানি কর্মকর্তা এই আক্রমণে নিহত হয়েছিলেন। আক্রমণের ছয় মাস পরে সরকারের আশ্বাস পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণকাজে অংশ নেয়। লাইন ৬-এর পূর্ণাঙ্গ একটি নকশা ২০১৬ সালের আগস্টে প্রস্তুত করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে দিয়াবাড়িতে রেলপথের ডিপোর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ২ আগস্টে এমআরটি লাইন ৬-এর প্রথম পর্যায়ের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
নির্মাণকাজ শেষ করতে ডিএমটিসিএল সাতটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আবদুল মোনেম লিমিটেড, যা ছিলো এই নির্মাণ প্রকল্পে নিযুক্ত একমাত্র বাংলাদেশি ঠিকাদার। এছাড়া প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের ঠিকাদার ছিলো ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।২০১৮ সালের মধ্যে যাত্রাপথের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের ইউটিলিটি স্থানান্তর শেষ হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিলে রেলপথের স্তম্ভগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে স্প্যান স্থাপন করা শুরু হয়। একই বছরের আগস্টে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণাধীন রেলপথের আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার অংশে অবস্থিত ভায়াডাক্ট ও স্টেশনের কাজ শুরু হয়। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল অনুযায়ী ২০ কিলোমিটার রেলপথের ৮.১৫ কিলোমিটার অংশের ভায়াডাক্ট বসানো শেষ হয়। ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়তে থাকে, প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত বিদেশীরা কাজ করা বন্ধ করে দেশ ছেড়ে চলে যায়। মহামারী চলাকালে লকডাউনের ফলে কয়েক মাসের জন্য নির্মাণকাজ বন্ধ থাকে। সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু নিয়ম জারি করা সাপেক্ষে সরকার নির্মাণ কাজ চালানোর অনুমতি দিলে কাজ আবার শুরু করা হয়। ২০২১ সালে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মাঝে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দুটি অস্থায়ী চিকিৎসালয়, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র ও অস্থায়ী বাসভবন স্থাপন করে সরকার। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে রেলপথের প্রথম পর্যায়ের সব স্প্যান বসানো শেষ হয়। যাত্রাপথের সবগুলো ভায়াডাক্ট ২৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে শেয় হয়। ডিপোর নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হয়।
মেট্রোরেল-৬ এর অর্থায়ন:
মেট্রোরেল নির্মাণ ব্যায়ের ৫৮.৭৮% জাইকা এবং ৪১.২২% বাংলাদেশ সরকারের। এমআরটি লাইন ৬ রেলপথের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশের নির্মাণকাজের জন্য ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। জাইকা এই অর্থের ৭৫.৪৫% ঋণ হিসেবে প্রদান করেছে। নির্মাণ বাবদ ০.৭০%, পরামর্শ সেবা বাবদ ০.০১% ও ফ্রন্ট এন্ড ফি বাবদ ০.২% সুদে সরকার এই ঋণ নিয়েছে। ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এমআরটি লাইন ৬-এর সেবা চালুর দশ বছর পর্যন্ত আসল সমেত ঋণের সুদ প্রদান করতে হবেনা। রেলপথ চালুর ত্রিশ বছর মধ্যে সুদসমেদ সমস্ত টাকা পরিশোধ করতে হবে। কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণ কাজের জন্য প্রকল্পের বাজেট অতিরিক্ত ১১ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে মোট ৩২ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা করা হয়।
মেট্রোরেল চালুর দিনে আয় করে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৭২ টাকা। প্রথম ১০ দিনে ৮৮ লাখ টাকা আয় ও প্রথম মাসে মেট্রোরেল কোম্পানি ২.৪৫ কোটি টাকা আয় করে। প্রথম তিন মাসের মধ্যে ডিএমটিসিএল এর আয় ৬.২০ কোটি টাকা। ১৯ জুন ২০২৩ সালে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ সরকারকে ঋণের কিস্তি হিসেবে ৫৫.৩০ কোটি টাকা প্রদান করে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী কোম্পানি এই লাইন থেকে দৈনিক ২৫ লাখ টাকা আয় করে থাকে।
মেট্রোরেলে ট্রেনের সংখ্যা:
২০১৭ সালে ডিএমটিসিএল এমআরটি লাইন ৬-এর প্রাথমিক অংশের সেবাপ্রদানের জন্য কাওয়াসাকি হ্যাভি ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ৪ হাজার ২৫৭.৩৪ কোটি টাকা অর্থমূল্যে ২৪টি ৬ কোচবিশিষ্ট যাত্রীবাহী রেলগাড়ি অর্ডার করে। ১৬ এপ্রিল ২০১৯ সালে রেল কোচগুলো উৎপাদন শুরু হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় মেট্রোর একটি নমুনা ট্রেন এসে পৌঁছায়। প্রথম ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২১ সালের এপ্রিলে পৌঁছায়। বাকি ট্রেনগুলো ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে পৌঁছে যায়। এমআরটি লাইন ৬-এর রেলপথে বর্তমানে কাওয়াসাকির তেরি ১২টি ট্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে । যার মধ্যে ২টি ব্যাকআপ ট্রেন হিসেবে রাখা হয়েছে। ট্রেনের প্রতিটি কোচ লম্বায় ১৯.৮ মিটার, প্রস্থে ২.৯৫ মিটার ও উচ্চতায় ৪.১ মিটার। কোচগুলো একসাথে ট্রেনে পরিণত হলে দৈর্ঘ্যে ১২০ মিটার হয়। ট্রেনগুলোর বিদ্যুতায়নে ওভারহেড লাইন ভিত্তিক ১৫০০ ভোল্ট ডিসি রেল ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে। দুটি শীতাতপ ইউনিট দ্বারা ট্রেনগুলোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার বেগে ট্রেনগুলো ভ্রমণ করতে সক্ষম। ট্রেনের জানালায় বুলেটপ্রুফ কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে। রেলে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে মতিঝিল, উত্তরা ও শেওড়াপাড়ায় ১৩২ কেভির তিনটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ট্রেনে একটি করে কোচ শুধুমাত্র নারীদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। ট্রেনগুলো ৬ কোচ বিশিষ্ট ২৪ সেট। তবে ভবিষ্যতে ৮ কোচে উন্নীত করা যাবে। কোচের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা, মাঝের ৪টি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন এবং ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনের সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ২৩০৮ জন।
মেট্রোরেলের টিকেটের সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা ও কিলোমিটার প্রতি ৫ টাকা ঠিক করা হয়েছে। মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য ডিএমটিসিএল এর আওতায় দুই ধরনের টিকেট/কার্ড রয়েছে। এগুলো হল- একক যাত্রার টিকেট এবং এমআরটি পাস। যে কোনো মেট্রোরেল স্টেশন এর নির্ধারিত টিকেট অফিস হতে নিবন্ধন ফর্মে তথ্য প্রদান করে ও নির্ধারিত প্রাথমিক মূল্য ৫০০ টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে এমআরটি পাস কেনা যাবে। এই পাসের মেয়াদ ১০ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত রিচার্জ বা টপআপ করা যায়।
মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের সুবিধা:
মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য যাতায়াত নিশ্চিতে প্রতিটি মেট্রো ট্রেনের সামনে একটি স্বতন্ত্র নারী কোচ আছে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৭৪ জন নারী যাত্রী শিশুসহ যাতায়াত করতে পারেন। নারী যাত্রীগণ ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারেন। গর্ভবতী নারী যাত্রীগণের জন্য মেট্রোরেল স্টেশনে লিফটের ব্যবস্থা আছে এবং মেট্রো ট্রেনে আসন সংরক্ষিত আছে। এতে করে নারী যাত্রীরা সহজে ও নিরাপদে কর্মক্ষেত্র ও প্রত্যাশিত স্থানে দ্রুততম সময়ে যাতায়াত করতে পারছেন। মেট্রোরেল স্টেশনসমূহে প্ল্যাটফর্মে নারী যাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে এবং এতে শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনের সুবিধা সংযোজিত আছে।
মেট্রোরেলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ:
এমআরটি লাইন ৬ পরিচালনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে উত্তরা ডিপো এবং মতিঝিল এলাকায় দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন রয়েছে। উত্তরা রিসিভিং সাবস্টেশনে পিজিসিবি এর টংগী গ্রিড সাবস্টেশন হতে ১৩২ কেভি এর একটি সার্কিট ও ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) এর উত্তরা গ্রিড সাবস্টেশন হতে ১৩২ কেভি এর অপর একটি সার্কিটের মাধ্যমে এবং মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) এর মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশন হতে ১৩২ কেভি এর দুইটি পৃথক সার্কিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উভয় রিসিভিং সাবস্টেশনে ব্যাকআপ হিসেবে একটি করে অতিরিক্ত ট্রান্সফর্মার রয়েছে। উপরন্তু পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থিত ডেসকো এর ৩৩ কেভি সাবস্টেশন হতে শেওড়াপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হয়েছে। ফলে মেট্রোরেল পরিচালনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কোন কারণে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া না গেলে মেট্রোরেলের বিশেষ জ্বালানি ব্যবস্থা হতে বিদ্যুৎ সরাবরাহ করে মেট্রো ট্রেনকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসা যাবে।
মেট্রোরেল যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্যোগ:
বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের নিয়ন্ত্রণ ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এজন্য সর্বাধুনিক স্বয়ংক্রিয় পরিচালনা ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে। মেট্রো রেলে যাতায়াতকারী যাত্রীর নিরাপত্তায় বিশেষ ধরনের প্রবেশদ্বার ও আইপি ক্যামেরসহ সিটিটিভি বসানো হয়েছে। আপৎকালীন মেট্রোরেলের ভেতর থেকে বের হবার জন্য জরুরি বহির্গমন দরজা আছে। মেট্রোরেল স্টেশন, রুট এ্যালাইমেন্ট ও মেট্রো ট্রেনে অনাকাঙ্খিত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীদের সুবিধায় সুদক্ষ কর্মীর পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আলাদা বিশেষায়িত এমআরটি পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়েছে।
ভাড়া ছাড়াও রাজস্ব আয়ের উদ্যোগ:
বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ভাড়ার আয় হতে লাভজনকভাবে মেট্রোরেল পরিচালনা করা যায় না। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো মেট্রোরেল পরিচালনার পাশাপাশি মেট্রোরেলের আন্তঃলাইন সংযোগ স্টেশন, ডিপো ও প্রধান প্রধান স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ক্রমান্বয়ে কেনাকেটার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই বাস্তবতায় এমআরটি লাইন-৬ লাইনের উত্তরা সেন্টার মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন ভূমিতেও একই ধরনের কেনাকাটার কেন্দ্র গড়ে তুলতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে ২৮.৬১৭ একর ভূমি বরাদ্দ গ্রহণ করা হয়েছে।
বরাদ্দ ভূমির মূল্য বাবদ প্রায় ৮৬৫ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা রাজউক-কে পরিশোধ করা হয়েছে। রাজউকের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক ধরণার পরিকল্পনাও প্রস্তুত করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তর কাজ করছে। মেট্রোর প্রতিটি লাইনের প্রধান প্রধান মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় সুবিধাজনক স্থানে ন্যূনতম ৪টি করে স্টেশন প্লাজা গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মেট্রোরেল ৬ লাইনের উত্তরা উত্তর, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় স্টেশন প্লাজা নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সংস্থার ভূমি হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্তির কার্যক্রম চলমান আছে। ইতোমধ্যে স্টেশন প্লাজাগুলোর নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। উত্তরা উত্তর ও কমলাপুর মেট্রোরেল টার্মিনাল স্টেশনে দীর্ঘ মেয়াদে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখারও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
মেট্রোরেল ব্যবহারে সচেতনতার উদ্যোগ:
অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেল সম্পর্কে জনসাধারণকে সম্যক ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে এমআরটি লাইন 6-এর উত্তরা ডিপো এলাকায় মেট্রোরেল এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেন্টারে মেট্রো ট্রেনের মক-আপ, মূল মেট্রো ট্রেন সেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচলে সক্ষম দুই সেট মিনি মেট্রো ট্রেন, মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে মিল রেখে টিকেট অফিস মেশিন, টিকেট ভেন্ডিং মেশিন এবং স্মার্টকার্ড উপযোগী স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ এবং বহিরগমন গেইট স্থাপন করা হয়েছে।
মেট্রোরেলের অভ্যন্তরে ও মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীগণের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয় সম্বলিত এ্যানিমেটেড কার্টুন প্রদর্শন করা হচ্ছে। এই বিষয়ে মেট্রোগার্ল স্কুলে যায় মেট্রোরেলে চড়ে শিরোনামে একটি কার্টুন পুস্তিকা মূদ্রণ করে দর্শনার্থীগণের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলের বায়ু দূষণ রোধে ভূমিকা:
মেট্রোরেল সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ চালিত বিধায় কোনো ধরণের জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে মেট্রোরেল দ্বারা বায়ু দূষণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেট্রোরেল অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করায ছোট যানবাহনের সংখ্যা কমে আসছে। এতে জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানীর ব্যবহার কমছে। ফলে মেট্রোরেলের এলাকায় বায়ুদূষণ কমতে শুরু করেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এমআরটি লাইন-৬ এর সম্পূর্ণ অংশ চালু হলে এই রুটে যানবাহনের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। এতে করে বছরে ২ লাখ ২ হাজার ৭৬২ টন কার্বন নিঃসরণ কমবে। তাই মেট্রোরেল বায়ু দুষণ রোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
শব্দ কম্পন দূষণ রোধ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মেট্রোরেল:
শব্দ ও কম্পন দূষণ রোধে এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের রেলওয়ে ট্র্যাকের নিচে বিশেষ ধরনের কম্পন সহনশীল স্তর ব্যবহার করা হয়েছে। ভায়াডাক্টের উভয় পার্শ্বে শব্দ প্রতিবন্ধক দেয়াল স্থাপন করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে মেট্রোরেলে শব্দ ও কম্পন দূষণ মাত্রা মানদণ্ড সীমার অনেক নিচে রয়েছে। সার্বিকভাবে শব্দ ও কম্পন দূষণে মেট্রোরেল কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। দেশের সম্পূর্ণ জিডিপিতে ঢাকার অবদান প্রায় ৩৬ শতাংশ। ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৫০ হাজার। ২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ ৯ হাজার ২৫৫টি। এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ জুন ২০২৩ তারিখে ২০ লক্ষ ১৯ হাজার ৯৪১টিতে উন্নীত হয়েছে।
ঢাকা মহানগরীর সড়ক ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৬.১২ কিলোমিটার মাত্র। উভয়ের প্রভাবে ঢাকা মহানগরীতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং ক্রমাবনতি হচ্ছে। এই যানজট এবং এর ফলশ্রুত প্রভাবে বার্ষিক প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করছেন।এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এমআরটি লাইন-৬ এর সম্পূর্ণ অংশ চালু হবার পর মেট্রোরেল পরিচালনা করার সময় দৈনিক ভ্রমণ ব্যয় বাবদ প্রায় আট কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা এবং যান চলাচলের ব্যয় বাবদ প্রায় এক কোটি ১৮ লক্ষ টাকা সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয় করা অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। শহরকেন্দ্রিক মানুষের যাতায়াত সহজ করতে অনেক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করা একটি পরিবহন মেট্রোরেল। এটিতে একইসঙ্গে যেমন অনেকে যাতায়াত করতে পারেন, তেমনি এড়ানো যায় যানজট। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবহারের দিক থেকে যাত্রীদের পছন্দের তালিকায় এটি অনেকটাই এগিয়ে থাকে।
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :