দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি-পাহাড় ধ্বংস, নদী-নালা, জলাশয়, খল, অপরিকল্পিত ভূমির ব্যবহার, মরা নদী, শিল্প দূষণ, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, প্রকৃতি-পরিবেশ দূষণের ফলে ঝড়, জলোচ্ছাস, বন্যা, তাপ প্রবাহ, শিলা বৃষ্টি, টর্নেডো, সাইক্লোন, প্রলয়, মহামারিসহ নানা প্রাকৃতিক বির্পযয় মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলছে। রাজধানী শহর ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে, সেখানে এখন পানির বদলে বিষাক্ত নর্দ্দমার স্রোত বয়ে যায়।
মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে— এটি এখন এক কঠিন সত্য। শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়ে বাতাসে মিশছে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের বার্ষিক গড় দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন), ১৮৬৬ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন) ও ৩৩২ পিপিবি। এসব তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণা থেকে।
যশোরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রচণ্ড গরম থাকার কারণ হিসেবে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদীর মৃতপ্রায় দশা ও সুন্দরবনের বিস্তৃতি কমে যাওয়াকে দায়ী করা হয়। সুন্দরবন একসময় যশোরের একটি অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিশ্বজুড়েই তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর উপায় খুঁজতে এখনো পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব। গবেষকদের বিশ্লেষণ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আগামীতে এক ভয়ঙ্কর পৃথিবী অপেক্ষা করছে মানব জাতির জন্য।
আবহাওয়া, জলবায়ু ও পানিজনিত ঝুঁকির কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে এশিয়া। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ার প্রেক্ষাপটে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। প্রতিবেদনে ডব্লিউএমও জানিয়েছে, ২০২৩ সালে এশিয়ায় প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রধান কারণ ছিল বন্যা ও ঝড়। অন্যদিকে তাপপ্রবাহের প্রভাব আরও তীব্র হয়েছে। বৈশ্বিক গড় উষ্ণতার চেয়ে দ্রুত উত্তপ্ত হচ্ছে এশিয়া। ১৯৬০-১৯৯০ সময়কালের পর থেকে উষ্ণায়নের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বন্যা, ঝড় ও আরও তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে হতাহত এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বিপদের মাত্রা এত দ্রুত বেড়ে চলেছে যে, প্রকৃতি ও মানুষের অভিযোজনের সক্ষমতাকে তা ছাপিয়ে যাবে এবং এমন একটি বাস্তবতার মুখোমুখি মানুষকে হতে হবে, যেখানে বন্যা, দাবানল আর খরায় লাখো জনতা উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে, হারিয়ে যাবে অনেক প্রজাতি এবং এই গ্রহের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টির ধরন ও ঝড়ের মাত্রা বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে আর্দ্রতা। বাংলাদেশেও এমন হচ্ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বিগত এক দশকে (২০১১-২০) ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮৫০-১৯০০-এর চেয়ে ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের কর্মকাণ্ডই পৃথিবীর জল, স্থল ও বায়ুমণ্ডলকে আশঙ্কাজনকভাবে উত্তপ্ত করে তুলছে। ২০৫০ সালের মধ্যে দেশগুলোর উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। বর্তমানে দেশগুলো যে গতিতে চলছে তাতে এই শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। অভিযোজনের জন্য মানবজাতি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে হুমকির মুখে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য অনেক দেশেরই থাকবে না।
বিজ্ঞানীরা গত শতকে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ খোঁজা শুরু করেন ৷ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তিরা মনে করেন, মানুষের কাজের জন্য সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়৷ আসল কারণ কী? প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছরের ইতিহাসে পৃথিবী কখনও হালকা, কখনও বা বেশি গরম অবস্থা ধারণ করেছে৷ সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরার সময় যখন তার অবস্থান সূর্যের কাছে এসেছে তখন পৃথিবী বেশি গরম ছিল, আর যখন সূর্য আর পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব বেশি ছিল, তখন পৃথিবী অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ছিল। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক হাজার বছরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বিবেচনা করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ৷ এতে দেখা যায়, কয়েকশ বছর ধরে তাপমাত্রায় তেমন পরিবর্তন না হলেও বিংশ শতাব্দীতে এসে তা অনেক বেড়ে গেছে।
এরপর ২০১৩ সালে ‘সায়েন্স` জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ১১ হাজার বছরের তথ্য ব্যবহার করা হয় ৷ সেখানেও প্রায় একই রকম ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ সবশেষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার পর গত শতকে পৃথিবী আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত গরম হয়েছে। এই গবেষণায় আরও বলা হয়, গত দুই হাজার বছরে পৃথিবী সূর্যের কাছাকাছি ছিল। ফলে এই সময়টা মোটামুটি ঠাণ্ডা থাকার কথা। কিন্তু তাপমাত্রা অপ্রত্যাশিতভাবে বেশি থাকার কারণে ঠাণ্ডা অবস্থাটা বোঝা যায়নি।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ডাব্লিউএমওর ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট ২০২০` রিপোর্ট বলছে, গতবছরের গড় তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের (১৮৫০-১৯০০ সাল, যখন জীবাশ্ম জ্বালানি তত ব্যবহৃত হত না) তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। মানুষের কার্যক্রমের কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ‘জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম বড় কারণ` বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা আইপিসিসি ২০০১ সালে জানিয়েছিল, শিল্পযুগ শুরুর আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কয়েক হাজার বছর ধরে ২৮০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) ছিল৷ ১৯৯৯ সালে সেটা বেড়ে ৩৬৭ পিপিএম হয়৷ আর গত মে মাসে সেটা আরও বেড়ে ৪১৫ পিপিএম হয়েছে - সবশেষ প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এত বেশি ছিল। তখন সাগরের পানির তাপমাত্রা প্রায় ৩০ মিটার বেশি ছিল এবং সেই সময় আধুনিক মানব সভ্যতার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের উপর প্রকাশিত প্রায় ১২ হাজার গবেষণার সারমর্ম পর্যালোচনা করে ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ক্যানাডার বিজ্ঞানীরা এসব গবেষণা পর্যালোচনা করেছিলেন। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন জানায়, ১২ হাজার গবেষণার মধ্যে ৩২.৬ শতাংশ গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে মানুষ দায়ী, সেই ধারণাকে সমর্থন জানানো হয়। ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ গবেষণায় এই ধারণার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। আর মাত্র এক শতাংশেরও কম গবেষণায় ঐ ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়। ২০১৯ সালের প্রথম সাত মাসে জলবায়ু পরিবর্তনের উপর প্রকাশিত ১১ হাজার ৬০২টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে জানানো হয়, শতভাগ বিজ্ঞানী বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য যে মানুষই দায় সে ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
নাসার জলবায়ু বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন কুক বলেন, বিশ শতকের শেষদিকে বিজ্ঞানীরা যখন বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ খোঁজা শুরু করেন তখন তারা সম্ভাব্য চারটি কারণের কথা মাথায় রেখেছিলেন- গ্রিনহাউস গ্যাস, সৌরশক্তি, ওশান সার্কুলেশন ও ভলকানিক অ্যাক্টিভিটি৷ ‘‘এর মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ও শিল্পকরণের কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনই একমাত্র বিষয়, যেটা আমরা এখন যে ধরনের বৈশ্বিক উষ্ণতা দেখছি, সে সম্পর্কে আভাস দিয়েছিল,`` বেঞ্জামিন কুক। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে মানুষই দায়ী সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যতটা তারা মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব নিয়ে ছিল।
ডব্লিউএমও বলছে, গত বছর এশিয়ায় ৭৯টি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল বন্যা ও ঝড়। এর ফলে ২ হাজারের বেশি লোক মারা যায় এবং ৯০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি এশিয়ার দেশ হংকংয়ে এক ঘণ্টায় ১৫৮.১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা ১৮৮৪ সালে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ। এশিয়ার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের বেশিরভাগ হিমবাহ রেকর্ড পরিমাণ ভাঙা পড়েছে এবং উচ্চ তাপমাত্রা ও শুষ্ক অবস্থার কারণে উল্লেখযোগ্য ভর হারিয়েছে।
২০২৩ সালে হিমালয়, বিশেষ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালায় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন খরার শিকার হয়েছিল। বৃষ্টিপাতের মাত্রা বছরের প্রায় প্রতিটি মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল। ডব্লিউএমও প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৩ সালে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল রেকর্ডের সর্বোচ্চ। এমনকি আর্কটিক মহাসাগরও সামুদ্রিক তাপপ্রবাহের শিকার হয়েছিল, যেখানে বরফের চাঁদরে ঢাকা থাকে চারপাশ। আরব সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব লাপ্তেভ সাগরসহ অনেক অঞ্চলে সমুদ্রের পৃষ্ঠ বিশ্বের তুলনায় তিনগুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। প্রতিবেদনে ব্যারেন্টস সাগরকে `জলবায়ু পরিবর্তনের হটস্পট` হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ডব্লিউএমও প্রধান সেলেস্তে সাওলো এক বিবৃতিতে বলেছেন, এশিয়া অঞ্চলের অনেক দেশ ২০২৩ সালে তাদের রেকর্ডে থাকা সর্বোচ্চ উষ্ণতম বছর পার করেছে। পাশাপাশি খরা ও তাপপ্রবাহ থেকে শুরু করে বন্যা ও ঝড়ের মতো চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনাগুলো বেড়েই চলছে।
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :