গ্যাস লাইনে লিকেজ রাজধানী ঢাকার মতো জনবহুল শহরে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে ঢাকাবাসী। গত বছরের ১ মে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা বাজারে গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ৮ জন দগ্ধ হন। পরে ৬ মে হাসপাতালে দগ্ধ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান শাওনের মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালে রাজধানীর মিরপুর রোডে গ্যাসলাইনে লিকেজের কারণে একটি বাস এবং একটি পিকআপে আগুন লাগে। ২০১৬ সালে টঙ্গির টোম্প্যাকো ফয়েল লিমিটেড কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে অবৈধ গ্যাস থেকে। এছাড়াও ২০২১ সালে মগবাজারে বিস্ফোরণ, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণ এবং পরে সায়েন্স ল্যাব মোড়ের দুর্ঘটনা গ্যাস লিকেজ থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। রাজধানী ও এর আশপাশে প্রায়ই গ্যাসলাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও টনক নাড়েনি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের। ফলে এখনও রাজধানীর যেখানে-সেখানে গ্যাসলাইন লিকেজ ও এর ফলে দুর্ঘটনা হচ্ছে।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার কলতাবাজার, টায়ারপট্টি, বাংলাবাজার, কাজী আব্দুর রউফ লেন, হাজী আব্দুল মজীদ লেন, বংশাল, পাতলা খান লেন, নবাবপুর, ধোলাইখাল, ৫ ভাই ঘাট লেন, রসের গলি, ডাইলপট্টি, খোকার মাঠ, বানিয়ানগরসহ বিভিন্ন জায়গায় গ্যাসলাইন লিকেজের কারণে সেসব এলাকার অলিগলির বাতাসে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিন দেখা গেছে,
ওইসব এলাকায় মূল সরবরাহ লাইন থেকে গ্রাহকের বাড়িতে যাওয়া লাইনের সংযোগস্থলের রাইজার থেকে গ্যাস বের হয়ে অলিগলিতে গন্ধ ছড়াচ্ছে। পুরান ঢাকার এসব ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে নানান ধরনের কেমিক্যাল গোডাউন, টায়ারের দোকান এবং কাগজের দোকান। এসব লিকেজ ওই এলাকাকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের বাসিন্দা আসফাক উল্লাহ বলেন,
বাংলাবাজারে বিভিন্ন প্রিন্টের কারখানা রয়েছে। এখানে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল আছে। যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে পুরো এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পরবে। বাংলাবাজার ও শিংটোলার একাধিক গলিতে গ্যাসলাইন লিকেজ হয়ে গ্যাসের গন্ধ বের হয়। প্রায় সবসময়ই এদিকে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার বিষয়টা আমরা জানিয়েছি। তারা এসে দেখেও গেছে, কিন্তু গন্ধ যায়নি।
হাসান আলী নামে পুরান ঢাকার টায়ারপট্টির এক বাসিন্দা বলেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের অবৈধ গোডাউন সরানোর কথা সবসময় পত্রপত্রিকায় শুনলেও এর কার্যকারিতা দেখি না। এসব অবৈধ গোডাউন আমাদের অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। তার ওপর গ্যাসলাইন লিকেজ এক নতুন উদ্বেগের বিষয়। প্রায় সময় অলিগলিতে গ্যাসের তীব্র গন্ধ থাকে। গ্যাসলাইনের লোক এসে দেখে বলে বাসাবাড়ির গ্যাস। লাইনে কোনও সমস্যা নেই। শিগগিরই লিকেজ সমস্যার সমাধান না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
গ্যাস লিক হওয়ার পেছনে অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে না পারা, মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন প্রতিস্থাপন বা সংস্কার না করা, গ্যাসের চাপ ও লিকেজ শনাক্তে স্বয়ংক্রিয় কোনও ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেছেন ভোক্তারা। হাজী শাহাবুদ্দিন নামে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের একজন বাসিন্দা বলেন,
অবৈধ সংযোগ নিতে পাইপলাইনে ছিদ্র করায় এবং নিয়মিত গ্যাসলাইন পর্যবেক্ষণ না করায় পুরান ঢাকার অলিগলিতে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। গ্যাসলাইনের অবস্থাও জরাজীর্ণ। তিতাসের জরুরি নম্বরে ফোন দিলেও সাড়া না মেলার অভিযোগও করেন তিনি।
গ্যাসলাইন লিকেজের বিষয়ে তিতাসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ঢাকার বেশিরভাগ গ্যাসের লাইন মাটির নিচ দিয়ে টানা। এগুলোর বয়স ৩০-৩৫ বছরের বেশি। এই লাইনের ওপরেই রাস্তার নির্মাণকাজ চলেছে, ভারী যানবাহন চলাচল করছে। একই পথে টানা হয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য ইউটিলিটি লাইন, যা গ্যাসলাইনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। গ্যাসের ধাতব পাইপগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হতে শুরু করে। গ্যাসলাইনগুলো মাটির চাপ, তাপ, ভূকম্পনসহ নানান কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক সময় মরিচা পড়েও লিকেজ হয় বলে জানান তারা।
পুরান ঢাকার অলিগলিতে গ্যাসের গন্ধ পাওয়া এবং এর প্রতিকারের বিষয়ে কথা হয় তিতাসের ইমারজেন্সি গ্যাস কন্ট্রোল সেকশন (সাউথ)-এর আল আমিন নামে একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন,
শুধু পুরান ঢাকা না, পুরো ঢাকা সিটির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। পরে আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধান করি। পুরান ঢাকায় রাইজার থেকে গ্যাস বের হয়ে গন্ধ পাওয়ার অভিযোগ অনেক আসে। পরে আমাদের ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্ট থেকে লোকজন গিয়ে সমস্যার সমাধান করে। গ্যাস সংক্রান্ত যেকোনও সমস্যায় ১৬৪৯৬ নম্বারে কল করার কথাও জানান এই ব্যক্তি।
এ বিষয়ে তিতাসের অপারেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বলেন, গ্যাসলাইন লিকেজের অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য আমাদের নর্থ-সাউথসহ তিনটি বিভাগ আছে। তারা লিকেজের অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক সমাধান করে। কেউ বলতে পারবে না যে অভিযোগ দিয়ে কোনও প্রতিকার পায়নি। হয়তো সিরিয়াল বেশি হয়ে গেলে একটার পর একটা যায়। এতে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে না পৌঁছালেও কিছুটা বিলম্বে সেখানে পৌঁছে এবং সমস্যার সমাধান করা হয়। গ্যাস সংকট দেখা দিলে ইমারজেন্সি লাইনে অনেক কল আসে। তখন সবার কল রেসপন্স করা যায় না। তবে লিকেজের বিষয় ভিন্ন।
গ্যাসলাইনে লিকেজের বিষয়ে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন,
গ্যাসলাইন অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যাটা হচ্ছে। তাছাড়া অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস আমাদের গ্যাসলাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। আবার লিকেজটা কিছু সময় ন্যাচারালিও হয়। পুরনো গ্যাসলাইন নতুন করে প্রতিস্থাপন করার ব্যাপারে সেলিম মিয়া জানান, এটার জন্য একটা প্রজেক্ট নেওয়া হচ্ছে, যা চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এটা বাস্তবায়ন হলে পুরনো লাইন পরিবর্তন করে নতুন লাইন দেবো। এতে মানুষ স্বস্তি পাবেন।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :