ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে জুলাইয়ের মধ্যভাগে। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে আরেকটি ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা রয়েছে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে।
বন্যা র্পূবাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সামনের ১০ দিনের পূর্বাভাসে বলা হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতল আগামী ৪/৫ দিন বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি আগামী ৮/৯ দিন স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। পদ্মা নদীর পানি কতিপয় স্থানে বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। ঢাকার চার পাশের নদী সমূহের পানি আগামী ৮/৯দিন স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
সিলেটে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে তৃতীয় দফার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। তবে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বুধবার দুপুরের পর বৃষ্টি না হলেও সন্ধ্যা ও রাতে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ছয়টি পয়েন্টে আজ বৃহস্পতিবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত। মেরুং ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি। এছাড়া কবাখালি ইউনিয়নের ৫ গ্রামের পানি এখনো নামেনি। এছাড়া দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়াটার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজার। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পরেছে লংগদু উপজেলার বাসিন্দারা। খাগড়াছড়ি -লংগদু সড়কের একাধিক স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে।
কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৫১ সেন্টিমিটার এবং হাতিয়া পয়েন্ট বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে, কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি, পাটেশ্বরী পয়েন্টে দুধকুমার এবং শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলার পানি সামান্য হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) দুপুর ১২টায় যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যমুনার পানি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় সড়ক ভেঙে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আষাঢ়ের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফুলে-ফেপে উঠছে দেশের নদনদী। গত এক মাসে তৃতীয় দফা বন্যার কবল দেশ। বর্তমানে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার নিম্নএলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে অপরদিকে মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল। বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও পদ্মা নদীর পানি। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদনদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মুহুরী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীসমূহের পানি বেড়ে বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে । সর্বোপরী দেশের ১১০টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে ৯০টি স্টেশনে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমেছ ১৯টি ও অপরিবর্তিত রয়েছে একটি স্টেশনে। বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে ৯টি স্টেশনে। আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তত্সংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে বলে একটি নতুন সমীক্ষায় জানানো হয়েছে। ভবিষ্যতের বন্যা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য কম কার্বন নিঃসরণ পথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বান্দরবানে সাম্প্রতিক বন্যার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে বন্যা মোকাবিলা করার ক্ষমতা কমেছে। এতে করে মানুষের সুস্থতা ও সমৃদ্ধির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে এমন বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্র ০.২৫ শতাংশের জন্য দায়ী হলেও দেশটির ওপর এর প্রভাব মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন, তা না হলে বাংলাদেশের পরিণতি মারাত্মক হবে। বাংলাদেশে কার্বন নির্গমনে দায়ী মূলত কৃষি এবং জ্বালানি খাত। কৃষিখাতে ৪৪ শতাংশ এবং জ্বালানিখাতে ৩৯ শতাংশ কার্বণ নিঃসরণ হয়। ২০৪০ সালে এটি সর্বোচ্চ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কার্বণ নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে এবং জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি বাড়তে থাকলে ২০৭০ থেকে ২০৯৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহ সর্বনিম্ন ১৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে গুরুতর মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সংকটেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরণ, আকস্মিক বন্যার তীব্রতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবের কারণে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্বব্যাপী জরুরি ও বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
রিসার্চ সূত্রে আরও জানা গেছে, বৃহত্তর অভিযোজন পদক্ষেপ এবং স্থিতিস্থাপকতা-নির্মাণ ছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বন্যার মানবিক ও অর্থনৈতিক ব্যয়, যা ইতিমধ্যেই অনেক বেশি, তা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্যার কারণে ক্রমবর্ধমান মৃত্যু এবং অর্থনৈতিক ধ্বংস ইতোমধ্যে অনুভূত হয়। ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে, ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে এবং মোট ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ২০২২ সালের বন্যায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং ৭.৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জা.হা
আপনার মতামত লিখুন :