যানজট কমিয়ে রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দিতে দুয়ার খুলে দিচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের সড়ক পথের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হয়েছে বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে এর শেষ হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দর থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি হয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে এই প্রকল্প। রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য এটিই হচ্ছে সরকার কর্তৃক গৃহীত সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সংযোগ সড়কসহ এটির দৈর্ঘ্য হবে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার এবং ব্যয় হবে ১২২ বিলিয়ন টাকা।
ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড ১.০৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করেছে চায়না রেলওয়ে কন্সট্রাকসন কর্পোরেশন এর সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মানের জন্য। প্রথম ধাপের এয়ারপোর্ট-বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত অগ্রগতি শতভাগ। দ্বিতীয় ধাপের বনানী রেলস্টেশন-মগবাজার ও তৃতীয় ধাপের মগবাজার-চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রস্তুতিমূলক কাজ চলমান। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ এই প্রকল্পের পরীক্ষামূলক পাইলিং এর কাজ উদ্বোধন করা হয়।
২০২৩ সালের (২ সেপ্টেম্বর) বিকেল চারটা ছয় মিনিটে সুইচ টিপে রাজধানীর আগারগাঁও পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠের পাশে স্থাপিত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের ফলক আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে ২০ মার্চ ২০২৪ কারওয়ান বাজার র্যাম্প খুলে দেওয়া হয়। এই নিয়ে মোট ১৬টি র্যাম্প চালু হলো। এর আগে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশ খুলে দেওয়া হয়েছিল।
বহুল আলোচিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ আগামী আগস্টেই আবার শুরু হতে যাচ্ছে। বিমানবন্দরের কাওলা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে মগবাজারে গিয়ে থমকে ছিল। তিন বিদেশি ঠিকাদারের মধ্যে বিরোধের জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ। তবে ঠিকাদার তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধ এবং অর্থায়ন জটিলতা কেটে গেছে বলে জানিয়েছে প্রকল্পের প্রধান ঠিকাদার ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি (ইতালথাই)।
তারা জানিয়েছে,
নির্মাণ কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন পেয়ে গেছে। এখন নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু করার প্রস্তুতি চলছে। গত মে পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৪.৮১ শতাংশ। জাতীয় নির্বাচনের আগে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১.৫ কিলোমিটার অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন থেকে এতে যানবাহন চলাচল করছে। পরে কারওয়ান বাজার অংশে নামার সংযোগসড়ক বা ডাউন র্যাম্প খুলে দেওয়া হয় এ বছরের ২০ মার্চ। অর্ধেক খুলে দেওয়া অংশে সেতু বিভাগ ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাক্কলনের দ্বিগুণ গাড়ি চলাচল করছে। এ অবস্থায় প্রায় ২৫ শতাংশ বাকি থাকা এক্সপেসওয়ের নির্মাণ কাজ গত মার্চে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান,
প্রকল্পের প্রধান ঠিকাদার ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি (ইতালথাই) ইতোমধ্যে ভৌতকাজ আবার শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করেছে। একাধিক উৎস থেকে কোম্পানিটি প্রায় ৯৫০ মিলিয়ন ডলার পাবে বলে আশা করছে। এ পরিমাণ অর্থ বাকি থাকা ২৫ শতাংশের নির্মাণ কাজের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন অর্থায়নের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শেষ করার পাশাপাশি আগের ঋণ পরিশোধ ও সমন্বয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে।
এর আগে প্রকল্পের মূল ঠিকাদার ইতালথাই সুদের একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পটির জন্য ঋণছাড় বন্ধ রাখে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ও আইসিবিসি। ঋণছাড় অব্যাহত রাখার জন্য ব্যাংক দুটি ইতালথাইয়ের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার সিএসআই ও সিনোহাইড্রোর কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। এ নিয়েই বাধে জটিলতা। শেষ পর্যন্ত সিঙ্গাপুর ও ঢাকায় মামলায় গড়ায় বিষয়টি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাওলা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজের মেয়াদ সর্বশেষ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি) নির্মাণ করা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেশের দ্বিতীয় পিপিপি প্রকল্প। এর আগে সরকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার প্রকল্প শেষ করে পিপিপির আওতায়। নির্মাণ কাজে বেসরকারি অংশীদার ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটির ৫১ শতাংশ শেয়ারের মালিক থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতালথাই। অবশিষ্ট ৪৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক চীনের দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না শানদং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ (সিএসআই) ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বন্দ্বে বর্তমানে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের মূল নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামোর নির্মাণ ব্যয়ের ৭৩ শতাংশের জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) নামে পরিচিত। তিন ধাপে বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পটির প্রথম ধাপে বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭৯.৫৯ শতাংশ। তৃতীয় ধাপে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ১২.৪০ শতাংশ। প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৪.৮১ শতাংশ। ১০ মাস আগে চালু হওয়া প্রকল্পের অর্ধেক অংশে বর্তমানে প্রতিদিন ৫০ হাজারের বেশি গাড়ি চলাচল করে, যা প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম শাখাওয়াত আখতার গণমাধ্যমকে বলেন,
‘আগামী মাসে (আপিল বিভাগে) শুনানি আছে। তার আগে সিঙ্গাপুরের সালিশি বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত বা সমাধান আসতে পারে। তারপর পুরোদমে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। আশা করি আগামী বছরের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।’
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :