- সুন্দরবনের হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে চায় কর্তৃপক্ষ
- প্রাণ ফিরে পাবে সুন্দরবন সংলগ্ন ৫২টি নদী ও খাল
- বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা হবে সুন্দরবন এলাকার মানুষের
সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখাসহ অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সুন্দরবন সংলগ্ন ৫২টি নদী ও খালের তীরে ম্যানগ্রোভ বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। এর মাধ্যমে সুন্দরবনের উপরিভাগে হারিয়ে যাওয়া অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে চায় কর্তৃপক্ষ। জলবায়ু তহবিলের লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডে ফ্রান্সের দেয়া প্রতিশ্রুত অর্থ থেকে ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা ও আইইউসিএন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
গত মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ ও ডয়েচে গেসেলশ্যাফ্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল জুসামেনারবিট (জিআইজেড) বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্টিনা বুরকার্ড এই দুটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ দুটি প্রকল্পই জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষার উপর জোর দিয়ে লাইফ বিলো ওয়াটার এসডিজি ১৪ ও লাইফ অন ল্যান্ড এসডিজি ১৫-এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে এসডিজিতে অবদান রাখবে। এই উদ্যোগগুলি এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ও জার্মানির অঙ্গীকারের প্রতিফলন। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুন্দরবন ও সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডের সংরক্ষণ নিশ্চিত করে, সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টাগুলি উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সুন্দরবন ও সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা (এমপিএ) সোয়াচ নো গ্রাউন্ডের টেকসই ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরকালে পরিবেশ সচিব ফারহিনা আহমেদ বলেন, সুন্দরবন ম্যানগ্রোভস ও মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ড ইন বাংলাদেশ প্রকল্প পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবে।
পরিবেশ সচিব আরো বলেন,
‘সুন্দরবনের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন জোরদার এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার করা (সুন্দর-বে) প্রকল্পটি মার্চ ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৭ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সুন্দরবন সংরক্ষণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রচেষ্টার উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি বলেন, সুন্দর-বে প্রকল্পের লক্ষ্য দুই দেশের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয় উন্নত করা, সুন্দরবন সংরক্ষণে সহায়তা করা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী- বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য ইকোসিস্টেম পরিষেবা সরবরাহ করা। প্রকল্পটি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে, যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রচার করবে এবং টেকসই আয়-উৎপাদনমূলক কার্যক্রম ও পরিবেশগত শিক্ষার মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়কে সহায়তা করবে।
সুন্দরবনের উপরিভাগে ম্যানগ্রোভ বনে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এক সময় এর ভারসাম্য ধরে রাখতে বড় ভূমিকা রাখতো। তবে গত কয়েক দশকে গাছপালা কেটে মানববসতি তৈরি, নদীর পাড়ে বেড়িবাঁধ ও ঘের ইত্যাদি গড়ে তোলার কারণে বনসংলগ্ন ৫২টি নদী ও খালে কমে গেছে পানি প্রবাহ। কোথাও আবার এ প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে। এতে নদী ও খালের তীরবর্তী ম্যানগ্রোভ বন বিলীন হয়ে গেছে। ফলে সুন্দরবনে পানির স্বাভাবিক প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মিষ্টি আর লোনা পানির মিশ্রণে গড়ে ওঠা অনন্য বৈশিষ্ট্যের এ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধীরে ধীরে হারাতে থাকে তার বৈশিষ্ট্য। লবণাক্ততা বাড়ায় লবণসহিঞ্চু গাছের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, কমেছে লবণাক্ততা অসহিঞ্চু গাছের সংখ্যাও। এতে সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার স্বাভাবিক ভারসাম্য।
এ অবস্থায় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় ‘আপার সুন্দরবন রেস্টোরেশন’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে বন বিভাগ। এর আওতায় বাগেরহাটের বলেশ্বর থেকে সাতক্ষীরার কালিন্দি নদী পর্যন্ত এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হবে। আইইউসিএন ও ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা সুন্দরবনের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে পাইলটিংয়ের মাধ্যমে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। গত বছরের ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বাংলাদেশ সফর করেন। ফরাসি সরকার জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে সহায়তা করতে চায় বলে তিনি জানিয়েছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা সুন্দরবন ও এর উপরিভাগে গ্রামাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকবিলার জন্য আইইউসিএন বাংলাদেশের সহায়তায় ‘আপার সুন্দরবন রিস্টোরেশন প্রোগ্রাম’-এর উদ্যোগ নিয়েছে।
বন সংরক্ষক খুলনা মিহির কুমার দো বলেন,
ফ্রান্স সরকারের সহায়তায় এটি একটি পাইলট প্রকল্প। সুন্দরবনের বাইরের একটি বিশাল অঞ্চল নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ৩ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের আওতায় থাকবে প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা, প্লানটেশন সহ জীববৈচিত্র রক্ষায় নানা আয়োজন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সুন্দরবন এলাকার নদীগুলো একদিকে যেমন প্রাণ ফিরে পাবে, তেমনি সুন্দরবনের পানি প্রবাহও বাড়বে। ফলে লবণ ও মিষ্টি পানির মিশ্রণের যে অসাধারণ বৈশিষ্ট্য সুন্দরবনে আছে, তা ধরে রাখতে সহায়তা করবে। এটা একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যেমন ধরে রাখবে, তেমনি জীববৈচিত্র্য ধরে রাখতেও ভূমিকা রাখবে। এর ফলে মাছের সংখ্যাও বাড়বে।’এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবন এলাকার মানুষের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাও করা হবে। এই প্রকপ্লের সম্ভাব্য ব্যায় ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :