- কালো পানির স্থলে বিরাজ করছে স্বচ্ছ পানি
- বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তূপ
নদীমাতৃক দেশ এই বাংলাদেশ। আমাদের রাজধানী ঢাকাসহ অধিকাংশ বড় বড় শহর কোনো না কোনো নদীর কোল ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে। এই বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহরগুলোর সঙ্গে বয়ে চলা নদীর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বুড়িগঙ্গা নদী, যা বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য নদী। কিছুদিন আগেও এই নদীর পানি ছিল আলকাতরার মতো কালো। পানির দুর্গন্ধে নদীর পাড়ে যাওয়া যেত না। নাক চেপে খেয়াপারাপার হতেন যাত্রীরা। তবে এখন এই চিত্র পাল্টে গেছে। গত মাস থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি ও বর্ষার পানি বুড়িগঙ্গার ময়লা আবর্জনা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কালো পানির স্থলে বিরাজ করছে স্বচ্ছ পানি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিকাল হতেই ভ্রমণপিপাসুরা ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় বুড়িগঙ্গায়। মূলত দালান-কোঠার শহরে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সময় কাটাচ্ছে। দুপুর হতে না হতেই শিশু ও শ্রমিক শ্রেণির লোকজন গোসল করতে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আজ সোমবার সদরঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়ে দেখা যায়,
ঢেউয়ের উপরে ডেউ আছড়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে নদীপ্রেমীরা যেন আনন্দে আটখানা। কেননা বছরের বেশির ভাগ সময় বুড়িগঙ্গার পানি থাকে ঘোলা, কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত। বর্ষা আসতে না আসতেই পানির স্বচ্ছতা বুড়িগঙ্গার সবকিছুকেই পাল্টে দিয়েছে। মুক্ত হাওয়া বইছে এখন বুড়িগঙ্গার দু’পাড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসছেন বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন অংশে।
ঘুরতে আসা এক ভ্রমণপিপাসু বলেন, বর্তমানে বুড়িগঙ্গা কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বর্ষা মৌসুমের কারণে বুড়িগঙ্গা পেয়েছে ভরা যৌবন। বাতাস ছাড়লেই নদীতে ঢেউ তোলে। সেই ঢেউয়ে নৌকা দোল খায়। তার সঙ্গে দোলে যাত্রীরা। তিনি বলেন, বর্ষার সময় বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে নৌকা বাইচ হতো। কিন্তু এখন আর হয় না।
কথা হয় নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির সহ-সভাপতি রণজিত চন্দ্র সরকারের সঙ্গে। তিনি একুশে সংবাদকে বলেন,
নগরবাসীকে বিনোদন এবং বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য নৌকা বাইচ টিকিয়ে রাখতে এই সময়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইচ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা যেতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজানা ইয়াসমিন একুশে সংবাদকে বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী একটি জীবন্ত ইতিহাস। বর্ষা মৌসুমের আগে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকে। তখন এখানে আসায় কষ্টকর হত। দূষিত পানির দুর্গন্ধে নদীর পাড়ে যাওয়া যেত না। নাক চেপে আসা লাগত। এখন বর্ষা মৌসুম। বদলে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি এবং পানির রঙে ফিরেছে স্বচ্ছতা। সারা বছরই বিরাজ করুক বুড়িগঙ্গার এমন রূপ। তিনি বলেন, এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জেনেছি বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১২ ফুটেরও বেশি পলিথিন জমা হয়ে আছে। এসব পলিথিন অপসারণ করা গেলে শুষ্ক মৌসুমেও কিছুটা স্বচ্ছ পানি দেখা যেত।
বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়,
সেখানকার পানি আরও বেশি স্বচ্ছ। নদীর তীরে বেড়িবাঁধে বসে গল্পে মত্ত হাজারো মানুষ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে খোলা মোড়া থেকে সোয়ারীঘাট (ঠোডা) পড়ন্ত বেড়িবাঁধে ভিড় জমে যায়। বছিলা ব্রিজ, পোস্তগোলা ও বাবুবাজার ব্রিজের ওপর থেকে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভিড় জমান নগরবাসী।
নদী ভ্রমণে আসা একজন বলেন, পড়ন্ত বিকালের সূর্যালোকে মনে হচ্ছে বুড়িগঙ্গা যেন হাসছে। কিন্তু তার এ হাসি ক্ষণস্থায়ী। সারা বছর তার এ হাসি ধরে রাখতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের বিবেকবান মানুষজনকে।
বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী বসবাসকারীরা জানান,
এবার বর্ষা আসার আগেই নদীর পানি বদলাতে শুরু করেছে। এটাকে তারা ভালো লক্ষণ হিসেবে মনে করছেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হতে না হতেই বুড়িগঙ্গার পানি কালো রঙ ধারণ করে। তখন গোসল করাতো দূরের কথা, পানিতে হাত দেওয়ায় কষ্ট হয়ে যায়। পচা পানির গন্ধে দুই তীরের বাসিন্দাদের মাঝে দেখা দেয় পানিবাহিত নানা রোগব্যাধি।
কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম একুশে সংবাদকে বলেন, বর্ষা মৌসুমেই স্বচ্ছ পানি। মৃদু ঢেউ। বুড়িগঙ্গায় এমন দৃশ্য দেখা মেলে। গ্রীষ্মকালে নাকে রুমাল চেপে পারাপার হতে হয়।
৩০ বছর ধরে তৈল ঘাটে নদী পারাপার করছেন হোসেন মাঝি। তিনি বলেন,
আমরা এখন মনের সুখে নৌকা চালাই। শান্তিতে নদী পারাপার করি। বিকাল হলে বহু লোকজন ঘুরতে আসে। ঘণ্টা হিসেবে ভ্রমণ করে। অনেকে সখ করে নৌকা চালায়। আনন্দে তাদের সন্ধ্যা গড়ায়। তবে রাত হওয়ার আগেই সবাই ফিরে যায়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাট টার্মিনাল এলাকার পানি সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার হয়। প্রায় দুই যুগ আগেও অনেকে বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একসময় এ নদীতে ইলিশ মাছও পাওয়া যেত। ঢাকার মানুষের মাছের চাহিদার বড় অংশ সরবরাহ করতো এ নদী থেকে। তবে বর্তমানে জাল ফেলতেই উঠে আসে শাকার ফিশ। বুড়িগঙ্গা জুড়ে এখন শুধুই শাকার ফিশের রাজত্ব।
‘বুড়িগঙ্গা: নিরুদ্ধ নদী পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক এক গবেষণায় জানা যায়,
বুড়িগঙ্গা নদীর সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ওয়াশপুর থেকে হযরতপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার ভরাট, দখল ও প্রবাহশূন্যতার শিকার হয়ে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ২৫ কিলোমিটার প্রবহমান রয়েছে।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সভাপতি ড. কবিরুল বাশার একুশে সংবাদকে বলেন, বিআইডব্লিইটিএ’র গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তূপ জমে গেছে। বর্তমানে এর চাইতে বেশি পলিথিনের স্তূপ জমে আছে। বুড়িগঙ্গায় এই স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ধরে রাখতে হলে তলদেশে জমে থাকা অবশিষ্ট পলিথিনও দ্রুত অপসারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে বুড়িগঙ্গায় যাতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে না পারে সেদিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
বুড়িগঙ্গার নদীর দুই পাড় এখন অবৈধ প্লাস্টিক কারখানার দখলে। সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দূষিত প্লাস্টিক বর্জ্য ধোয়া হচ্ছে। এতে বুড়িগঙ্গার পানি যেমন দূষণ, তেমনি তা আশপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ওই পানি ব্যবহারে মানুষের চর্মরোগ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুস ড্যামেজসহ নানারকম রোগব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
প্রায় ৪০০ বছর আগে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা নগরী গড়ে ওঠে। সেই বুড়িগঙ্গা আজ প্রাণহীন প্লাস্টিক আর পলিথিনের বর্জ্য নদীর দুই প্রান্তে গড়ে উঠেছে শত শত প্লাস্টিকের কারখানা। সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করা পলিথিন আর প্লাস্টিক ধোয়ার কাজে ব্যবহার হয় বুড়িগঙ্গার পানি।
নদী বাঁচাও আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ক্ষতির কথা ভেবে দেশে ২০০২ সালে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও দেশে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। যার বেশিরভাগ ফেলা হয় নদীতে। এর প্রভাবে মানুষ, পশুপাখি ও প্রাণী ও আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূলত পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগেই অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে। প্লাস্টিকের এ ভয়াবহতা রুখতে পরিবেশ অধিদপ্তরকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
একুশে সংবাদ/এ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :