এ পর্যন্ত পাঁচটি ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়ছে স্পেন ও ফ্রান্স। আগামীকাল ইউরো ২০২৪’র প্রথম সেমিফাইনালে যে কারনে বিশ্ব ফুটবলের দুই পরাশক্তির জমাট লড়াইয়ে আশা করছে পুরো ফুটবল বিশ্ব। এই ম্যাচে জিততে পারলে স্পেন রেকর্ড চতুর্থ শিরোপার দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে ফ্রান্সের সামনে সুযোগ থাকবে স্পেন ও জার্মানির সমান তিন শিরোপা রেকর্ডে ভাগ বসানোর।
২০’শতকে জার্মান ও ইতালিয়ান আধিপত্যের কাছে অনেকটাই ঢাকা পড়ে ছিল ফ্রান্স ও স্পেনের ফুটবল। কিন্তু ধীরে ধীরে সাম্প্রতিক দশকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও সফল দুই ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমান করেছে ফ্রান্স ও স্পেন।
১৯৮৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জয়ের পর এ পর্যন্ত ১৩টি বিশ^কাপ ও ইউরোর ফাইনালের মাত্র চারটিতে এই দুই দলের কোন দল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি। এ সময়ের মধ্যে স্পেন দুটি ইউরো ও বিশ্বকাপ জিতেছে। অন্যদিকে ফ্রান্স দুইবার বিশ্বকাপ ও ২০০০ সালে একবার ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা ঘরে তুলেছে।
আগামী ১৪ জুলাই বার্লিনে ফাইনালে জায়গা করে নেবার পথে এই দুই দলের লড়াইয়ে কাল যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে :
ফ্রান্সের আক্রমনভাগের নিষ্ক্রিয়তা বনাম স্পেনের ক্ষয়প্রাপ্ত রক্ষনভাগ :
২০২২ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১৬ গোল করা ফ্রান্স ইউরোর সেমিফাইনালে এসেছে ওপেন প্লেতে কোন গোল না করেই। এটা ইউরোর ইতিহাসে একটি বিরল রেকর্ডও বটে। সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপ্পে মাত্র একবার জালের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটাও আবার পেনাল্টি স্পট থেকে গোল করে। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে আসরের প্রথম ম্যাচেই গুরুতর আহত হয়ে নাক ভেঙ্গে যাওয়ায় তাকে পরবর্তী ম্যাচগুলোতে মাস্ক পড়ে খেলতে হয়েছে। যে কারনে স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছেন না বলে এমবাপ্পে নিজেই স্বীকার করেছেন।
এছাড়া ফ্রান্সের বাকি দুটি এসেছে আত্মঘাতি থেকে। ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশ্যম এমবাপ্পের পক্ষেই অবশ্য কথা বলেছেন, ‘আমার এই ফরোয়ার্ড ইতোমধ্যেই ইতিহাস রচনা করেছেন এবং সে আরো ইতিহাস রচনা করতে মুখিয়ে আছে। শতভাগ নিজের সেরাটা দিতে না পারলেও কিলিয়ান এখানে আছে।’
ইউরো ২০২০’তে অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার আঁতোয়ান গ্রিজম্যান ছয় গোল করেছিলেন। একইসাথে দুটি এ্যাসিস্টও করেছিলেন। কিন্তু জার্মানিতে তাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছেনা।
ফ্রান্স যদি কাল কোনমতে জিততে পারে তবে সেটা হবে স্পেনের ক্ষয়প্রাপ্ত রক্ষনভাগের কারনে। নিষেধাজ্ঞার কারনে স্পেনের রক্ষণভাগের এবারের আসরের দুই নির্ভরযোগ্য কান্ডারি অভিজ্ঞ ডানি কারভাহাল ও সেন্টার-ব্যাক রবিন লি নরমান্ড সেমিফাইনালে খেলতে পারছেন না। আলবেনিয়ার বিপক্ষে গ্রæপের শেষ ম্যাচ বাদে এই দুজন টুর্ণামেন্টের অন্য ম্যাচগুলোতে মূল দলে খেলেছেন। এই দুজন একসাথে মাঠে থাকাকালীন স্পেন এ পর্যন্ত মাত্র এক গোল হজম করেছে।
৩৮ বছর বয়সী জেসুস নাভাস হয়তো কারভাহালের স্থানে মূল দলে ফিরতে পারেন। ফরাসি সুপারস্টার এমবাপ্পেকে আটকাতে হলে অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন রয়েছে।
বাস্তববাদী বনাম ইতিবাচক : দেশ্যম বনাম লুইস ডি লা ফুয়েন্তে
আগামীকাল দুই দলের কোচের মধ্যেও একটি লড়াই দেখতে প্রস্তুত হয়ে আছে ফুটবল প্রেমীরা। দর্শনের দিক থেকে দুই কোচের ভিন্ন মত থাকলেও লক্ষ্য কিন্তু একটাই, ১৪ জুলাই বার্লিনের ফাইনাল।
ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশ্যম ফুটবল ইতিহাসের তৃতীয় ব্যক্তি যিনি খেলোয়াড় ও ম্যানেজার হিসেবে বিশ^কাপ জয়ের রেকর্ড গড়েছেন। শেষ চারটি বড় টুর্নামেন্টের তিনটিতেই তার অধীনে লেস বøুজরা ফাইনালে খেলেছে। এবারের আসরের অন্য যেকোন দলের তুলনায় অন্যতম শক্তিশালী আক্রমনভাগ নিয়ে মাঠে নামলেও দেশ্যম কখনই তার স্ট্রাইকারদের উপর কোন কিছু চাপিয়ে দেননি। বরং দলের কাঠামো ভেদে রক্ষনভাগকেই তিনি বেশী স্থিতিশীল করার কৌশল অবলম্বন করেছেন। ইউরা বাছাইপর্ব শেষে দেশ্যম স্বীকার করেছিলেন তিনি সবসময়ই বাস্তববাদী ও বাস্তবসম্মত চিন্তা করতে পছন্দ করেন। খেলোয়াড়রাও কোচের এই নীতি সম্পর্কে অবগত।
পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র তিন গোল করলেও ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের এবারের আসরে ফ্রান্স কখনো পিছিয়ে পড়েনি।
বিপরীতে স্প্যানিশ কোচ লুইস ডি লা ফুয়েন্তে কখনই তার দলের দড়ি টেনে ধরেননি। মাঝে মাঝে তিনি তার দলকে স্বাধীনভাবে ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি তারা যদি কোন ভুলও করতো সেটাও তিনি আমলে নিতেন না। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ৩-০ গোলে জয়ের পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিপক্ষকে অনেক দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্থ করে দিয়েছি।’
এ পর্যন্ত স্পেনের হয়ে আটজন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড় স্কোরশিটে নাম লিখিয়েছেন।
মধ্যমাঠে কান্তে বনাম রড্রি :
স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রড্রি দাবী- তিনি যদি ম্যাচ খেলার জন্য প্রয়োজনীয় হন তবে হয়তোবা দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারেন। যা ফ্রান্সের হয়ে দীর্ঘদিন যাবতও এন’গোলো কান্তে দেখিয়ে আসছেন। ম্যানচেস্টার সিটির এই তারকা মধ্যমাঠে ম্যাচের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ধীরে ধীরে দলকে বল যোগান দিয়ে যান। তার কারনেই এ পর্যন্ত ইউরোতে তরুণ দুই উইঙ্গার লামিন ইয়ামাল ও নিকো উইলিয়ামস আক্রমনভাগে নিজেদের প্রমান করে চলেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে রড্রি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছেন। জর্জিয়ার বিরুদ্ধে শেষ ষোলর ম্যাচে বিরতির ঠিক আগে তার গোলে স্পেন ১-০ গোলে এগিয়ে যায়।
এদিকে কান্তের সাহসিকতা, এনার্জি ও দৃঢ়তা প্রায় এক দশক ধরে ফ্রান্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। মাঝে মাঝে আক্রমনভাগের খেলাও মধ্যমাঠে কান্তের দৃঢ়তার কাছে ফিকে হয়ে যায়। ৩৩ বছর বয়সী কান্তে এবারের আসরে ফ্রান্সের প্রথম দুই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। ইনজুরির কারনে দুই বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনুপস্থিতির পর আবারো ফিরে এসে নিজেকে নিয়ে গেছেন আগের সেই উচ্চতায়।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :