শীত আর বর্ষা, এ দুই সময়ে হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায় বহু গুণ। যান্ত্রিকতায় মোড়ানো শহুরে জীবনকে কিছু দিনের জন্য হলেও বিদায় জানিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় অজানায়। আর সেই অজানা যদি হয় হাওর বেষ্টিত অঞ্চল, তাহলে তো আর কথাই নেই। হাওরের কথা আসলেই প্রথমে যে নামটি আসে তা হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। ‘হাওর কন্যা’ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিশাল জায়গা জুড়ে এ হাওরের রাজত্ব।স
দেশের অন্যতম সুন্দর, বড় ও জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির হাওর। দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকির অবস্থানও মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায়। পরিযায়ী পাখি আর দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য এ হাওর সুন্দরবনের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’।
টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত সুনামগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১২০ টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। এছাড়াও এ হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষা মৌসুমে সব খাল, বিল ও নালা মিলেমিশে একাকার হয়ে রূপ নেয় সমুদ্রে। তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার ২ লক্ষ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি।
টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশি মাছের আধার বা ‘মাদার ফিশারিজ’। এ হাওরে আছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির বেশি স্বাদু পানির মাছ। এছাড়াও হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি ও ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমিও এই হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায়ই দেখা মেলে বিরল প্রজাতির প্যালাসার ফিশ ইগলের।
টাঙ্গুয়ার হাওরের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। বর্ষা মৌসুমে এ হাওরের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে থাকে আর শীতের শুরুতে ধীরে ধীরে পানি কমতে শুরু করে। শীতে হাওরের পানি তলানিতে ঠেকে। তখন হাওরের বড় একটা অংশই শুকিয়ে যায়। গাছ, মাছ, পাখি আর প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্যের আধার এই হাওর পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের জন্য বর্ষাকালকে আদর্শ সময় ধরা হলেও অনেকেই অতিথি পাখি দেখার জন্য শীতকালেও হাওরে ঘুরতে যান।
টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপের বিবরণ লিখে শেষ করার মতো নয়। বর্ষা ও শীত এই দুই মৌসুমে দুই রকমের সৌন্দর্যে রূপে-গুণে অনন্য হয়ে ওঠে এ হাওর। তবে অধিকাংশ পর্যটকদের মতে, টাঙ্গুয়ার হাওর তার আসল সৌন্দর্যে সাজে বর্ষাকালে।
বর্ষায় দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচ গাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রাম গুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে হাওর পারে স্বাধীনতা উপত্যকা, শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী ডিসি পার্ক। হাওরে ঘেরা এ অঞ্চলে সারাদিনই আকাশে শুভ্র মেঘের ওড়া উড়ি চলে। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওরের জল। তখন পুরো এলাকাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়।
শীত মৌসুমে হাওরে জল কম থাকায় পায়ে হেঁটেই হিজল ও করচ বাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। এ সময় টাঙ্গুয়ার হাওর দেশি ও পরিযায়ী পাখির অন্যতম বড় অভয়ারণ্য। হাওরে সবচেয়ে বেশি পাখি দেখা যায় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে।
প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যান। একসময় মনে করা হতো এই হাওরে শুধু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেই ঘুরতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে থাকার জন্য আধুনিক ও আরামদায়ক নৌকা প্রচলিত হওয়ায় এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অনায়াসে এই হাওর ঘুরে আসা সম্ভব। এছাড়া পুরো হাওরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। পুরো হাওরকে দৃষ্টি সীমানায় নিয়ে আসতে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।
টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে এখন বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পর্যটকদের জন্য। বর্ষা মৌসুমে পর্যটকদের জন্য ভাড়ায় মিলে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বেশ কিছু ছোট–বড় নৌকা। তবে এসব নৌকা ভাড়া নিতে আগে থেকে যোগাযোগ করা ভালো। সম্প্রতি হাওরে নৌকা ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। হাওরে নৌকার পাশাপাশি রয়েছে স্পিডবোটও। তবে স্পিডবোটের ভাড়া তুলনামূলক ভাবে বেশি। যারা খুব কম সময়ে হাওরে ঘুরতে চান তাদের জন্য স্পিড-বোট ভালো।
টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে অনন্য সুন্দর ‘জাদুকাটা` আর ‘পাতলাই` নদী। হাওর ভ্রমণের পাশাপাশি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এ দুই নদী। এই দুটি নদীর পানি যেমন টলটলে, তেমনি এর দুই পাশের দৃশ্যও অনন্য সুন্দর। জাদুকাটা নদী ধরে চলে যাওয়া যায় ভারত সীমান্তবর্তী বারেকের টিলায়। আর জাদুকাটা তীরের বিশাল শিমুল বাগানও ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফুলে ফুলে ভরা থাকে।
কিভাবে যাবেন
টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার জন্য প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সরাসরি সুনামগঞ্জে যাওয়া যায়। এছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট হয়ে সেখান থেকেও সহজেই সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর যেতে হবে লেগুনা কিংবা অটো রিকশায়। এছাড়াও এ পথে মোটরবাইকেও যাত্রী পরিবহন করা হয়৷
তাহেরপুর থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন রকম নৌকা ভাড়ায় পাওয়া যায়। এ নৌকাগুলো সাধারণত টাঙ্গুয়ার হাওরের মূল প্রবেশমুখ গোলাবাড়িতে নোঙ্গর করে। হাওরের ভেতরের পাখির অভয়ারণ্যে কোনো ইঞ্জিন চালিত নৌকা চালানোর অনুমতি নেই। তাই সেখান থেকে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছোট নৌকা ভাড়া করতে হবে।
একুশে সংবাদ.কম/ঢা/বাইজীদ_সা’দ
আপনার মতামত লিখুন :