পদ্মা সেতু দক্ষিণ অঞ্চলের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এ সেতুর দ্বার উন্মোচিত হওয়ার পর থেকেই ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। কুয়াকাটায় আসতে যেমন কমছে পথ তেমনি সময়। একই যায়গায় দাড়িয়ে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের দেখা আর নিঃসীম জলরাশির দেখা মেলায় পছন্দের তালিকায় থাকে কুয়াকাটা। তবে এমন মনোমুগ্ধকর সৈকতে ও সৈকতের আশেপাশে নানা অব্যবস্থাপনা বিরাজমান থাকায় অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও অবহেলায় আর অযত্নে থাকে পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। নানা অব্যস্থাপনা দূর করা গেলেই কুয়াকাটা হয়ে উঠবে সম্ভাবনাময় পর্যটন নগরী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতের প্রবেশ দাড়ে স্তুপ করে রাখা হয়েছে বালু ও জিও টিউবের বস্তা। পর্যটক যখন কুয়াকাটার সৈকতে নামতে চান সেই নামার রাস্তাটুকু করা নেই। পুরো সৈকত জিও টিউব আর জিও ব্যাগের দখলে। এলোমেলো ভাবে পড়ে থাকা জিও ব্যাগে শেওলা জমে সেগুলো হয়েছে মানুষ আহত হওয়ার ফাঁদ। প্লাস্টিক ও আর্বজনায় সয়লাব পুরো সৈকত। পর্যটকের শুরুটাই হয় বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে। জিরো পয়েন্টের আশে পাশে গড়ে উঠছে নানা ধরনের খুপরি ঘড়। সৈকতে দায়িত্বরত ট্যুরিস্ট পুলিশের সামনেই চলে নানা ধরনের যানবাহন। এতে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আগত পর্যটকরা। সৈকতের পূর্ব পাশে রয়েছে মাছ ভাজার দোকান। যেগুলো থেকে নির্গত পঁচা পানি প্রতিনিয়ত সৈকতে মিশে যাচ্ছে। দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ পর্যটকরা। তারপর রয়েছে মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের উৎপাত। পর্যটকদের দেখা পেলেই পিছু নিয়ে চারিদিকে ঘিরে ধরে। উপরন্তু সৈকতে আলোকচিত্রীদের বিরক্তিকরণ। সব মিলিয়ে পর্যটকরা শান্ত পরিবেশ পায়না।
সমস্যাগুলো এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ কুয়াকাটায় পৌঁছলে শুরু হয় হোটেল বয়দের টানাহেঁচড়া।পর্যটককে ফুসলিয়ে নিয়ে যায় মানহীন আবাসিক হোটেলে। পছন্দের হোটেলেও উঠা মুসকিল হয়ে পড়ে তাদের যন্ত্রনায়। ব্যাগ ধরে টানা হেছড়া শুরু করে।
এখানেই বিড়ম্বনার শেষ নয়। কুয়াকাটার অভ্যন্তরিন যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই খারাপ। এখানকার মূল আকর্ষণীয় যায়গা হলো সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের স্থান। পর্যটকরা সেখানে যাওয়ার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে অথচ একটু বৃষ্টি হলেই এসব স্থানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে কুয়াকাটার মূল বেড়িবাঁধ গর্ত করে ফেলে রেখেছে ফলে পানি আর কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
এতদ সত্বেও কুয়াকাটায় আগত পর্যটকরা পাচ্ছেনা ভালো খাবারের নিশ্চয়তা। পঁচা আর বাসি খাবার নিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। গলাকাটা দাম নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। পর্যটকদের চাপ বুঝে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় আবাসিক হোটেল মোটেল ও রিসোর্টের দায়িত্বশীলরা। এসব মিলিয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন নগরী আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছেন তার স্বকীয়তা।
এছাড়াও কুয়াকাটা উন্নয়নে বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানদের নিয়ে যে কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে তা নামে মাত্র। বিচকে উন্নয়ন করতে যা করা দরকার তা না পরিলক্ষিত হচ্ছে না।কুমিল্লা থেকে আসা মোসাঃ ইয়াসমিন বলেন, অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল পরিবার নিয়ে কুয়াকাটায় আসব। আসলাম ঠিকই কিন্তু ভালো কিছু দেখলাম না। সৈকতটি নোংরা। সৈকতে হাটা যায় না জিও ব্যাগের কারনে। চারিদিকে ঝুপড়ি দোকান। নানা অসংগতি দেখলাম। আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত আমরাই নষ্ট করি। সৈকতটিতে নজর দেওয়া দরকার।
কুয়াকাটা ট্যুর অপারেটর এসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা ( টোয়াক)`র সেক্রেটারি কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটা নান্দনিক স্পটগুলোর কানেক্টিং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। সৈকতের নানা অসংগতি আছে। আমাদের কাছেও নানা ধরনের সমস্যার কথা পর্যটকরা বলে। আমরা সেগুলো দূর করার জন্য দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ করি।
কুয়াকাটার প্রথম শ্রেনীর আবাসিক হোটেল সিকদার রিসোর্ট এন্ড ভিলার্স`র এজিএম আল-আমীন বলেন, পর্যটকরা একবার আসলে দ্বিতীয় বার আর আসতে চায়না। বিরুপ মন্তব্য করে। এতটা সম্ভাবনাময় একটা পর্যটন নগরীকে পর্যটকবান্ধব গড়ে তুলতে পারলে সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতো।
কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মোতাবেল শরীফ বলেন, পর্যটন নগরী কুয়াকাটাকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য দফায় দফায় মিটিং করি কিন্তু সমস্যা আর দূর হয় না। ইতিমধ্যে আমরা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সাথে মিটিং সম্পন্ন করেছি। আমরা দিনে দিনে পথে বসে যাচ্ছি। পর্যটকরা মূখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কুয়াকাটা থেকে। এখনি এটার প্রতি নজর দেওয়া দরকার না হয় পর্যটক একেবারে আসা বন্ধ হয়ে যাবে।
কুয়াকাটা পৌরসভার পৌর প্রশাসক কৌশিক আহমেদ বলেন,আমরা রুটিন মাফিক পঁচা বাসি খাবারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি। পর্যটকদের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোন কাজই আমরা কাউকে করতে দেইনা। আমরা ইতিমধ্যে কয়েকটি হোটেলে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করেছি। আমাদের অভিযান অব্যহত থাকবে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ রিজিওনের এসপি মো. আনসার উদ্দিন বলেন, এক সময় এটার ব্যাপকতা ছিল এখন এটা অনেকটা কমে আসছে। আমরা আলোকচিত্রী ও মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি যাতে পর্যটকবান্ধব ব্যবহার করে। এরপরও যারা বিভিন্ন উৎপাত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগভাবে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আজ থেকে চার পাঁচ বছর আগে সিবিচকে প্রটেকশন করার জন্য জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছিল। তা কালের পরিক্রমায় ছিড়ে গিয়ে এখন দৃষ্টি কটু হয়েছে। কখনো পর্যটকরা বিড়ম্বনায় পড়ে। ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ইঞ্জিনিয়রের সাথে করে নিয়ে সৈকত সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়েছে। তারা আমাকে আস্বস্ত করেছে খুব শ্রীঘ্রই এগুলো অপসারণ করা হবে। বাকী সমস্যা নিরসনের জন্য খুব শ্রীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করব। বেড়িবাঁধের পূর্ব দিকের গঙ্গা মতি যাওয়ার পথের কাজ চলমান রয়েছে। আশা করি আগামী দেড় মাসের মধ্যে সমাপ্ত হবে। পশ্চিমে যাওয়ার জন্য ২কিঃমি রাস্তা প্রস্তাবিত রয়েছে।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :