AB Bank
ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩০

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

দুর্লভ উদ্ভিদ এবং বিপন্ন বিরল বন্যপ্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা লাউয়াছড়া, গিলে খাচ্ছে প্রভাবশালীরা


Ekushey Sangbad
হৃদয় দেবনাথ
০৮:০৭ পিএম, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
দুর্লভ উদ্ভিদ এবং বিপন্ন বিরল বন্যপ্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা লাউয়াছড়া, গিলে খাচ্ছে প্রভাবশালীরা

দখলের কবলে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের অন্যতম রিজার্ভ ফরেস্টখ্যাত চিরহরিৎ বন লাউয়াছড়া। দেশে বিদ্যমান ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। ১ হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বনটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। বিশ্বে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এই বন বিখ্যাত। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ। নিরক্ষীয় অঞ্চলের বর্ষাবন বা রেইনফরেস্টের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় এই বনে। একসময় বৃহত্তর সিলেটের সর্বত্রই এ ধরনের বন ছিল। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা বাগান সৃষ্টি, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং নির্বিচারে গাছ উজাড়ের ফলে ক্রমান্বয়ে  সংকুচিত হতে হতে মাত্র কয়েকটি স্থানে চিরহরিৎ এ বর্ষাবনের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। এছাড়া পর্যটকের মাত্রাতিরিক্ত চাপে স্বাভাবিক চলাচল করতে পারে না বনের প্রাণীরা।হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক মাইকেল টুড এর পরিচালনায় জুলভার্ণের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী করা অস্কার জয়ী মুভি ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ’ ছবির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়। 

নামান জাতের উদ্ভিদ আর জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ বন। আয়তনে ছোট হলেও এ বন যেন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভালুক, মায়া হরিণসহ (বার্কিং ডিয়ার), নানা প্রজাতির জীবজন্তু। পাহাড়ি মৃত্তিকা গঠিত উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে বিস্তৃত এ বনে সরীসৃপ আছে নানা প্রজাতির। তার ভেতর অজগর হচ্ছে অনন্য। এখানে পাওয়া যায় হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ। লাউয়াছড়া বনেই রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির উল্লুক। আর এই লাউয়াছড়াই দিন দিন ধ্বংসের ধারপ্রান্তে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, প্রভাবশালীদের বন দখল, অবাধে বৃক্ষনিধন, নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক করাতকল স্থাপন, বনের ভেতর রেল-সড়ক পথ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অসচেতনতাই এই বন ধ্বংসের অন্যতম কারণ।লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বিষয়টি এমন নয়, বরং দেশে যেটুকু বন এখনও অবশিষ্ট রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। 

১৯২৫ সালে বনায়ন করে সৃষ্ট বনরাজি এখন ঘন প্রাকৃতিক বনের আকার ধারণ করেছে। এর মোট আয়তন ১২৫০ হেক্টর। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখা মেলে নানা বিরল প্রজাতির পশু পাখি ও বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদের। নানান জাতের উদ্ভিদ আর বন্যপ্রাণীর জন্য বিখ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। বর্তমানে লাউয়াছড়ায় কি পরিমান বনভূমি আছে তা জানে না খোদ বন বিভাগ। বিগত কয়েক দশকে বিগত সরকার দলের প্রভাব খাটিয়ে সাবেক কৃষি মন্ত্রী সহ একটি নির্দিষ্ট গুষ্ঠি দখল করে নিয়েছে লাউয়াছড়ার চারিপাশ। বনের জমি দখল করে গড়ে তুলা হয়েছে চা-বাগান, লেবু-আনারস-বাগান, কটেজ, বাড়িসহ নানান স্থাপনা। বনের জমি নিজেদের দাবি করে কৌশলে মামলাও করে রেখেছে দখলদাররা। ফলে আইনি জটিলতায় দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না অবৈধভাবে দখলে থাকা লাউয়াছড়া বনের ভূমি। ফলে চরম হুমকিতে পড়েছে বন ও বন্যপ্রাণী।বনভূমি দখল ও বন উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।বনে খাদ্য সংকটের কারণে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। খাদ্য সংকটে লোকালয়ে গিয়ে নির্মম মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে বন্যপ্রাণীর । এদিকে দখলের দৌরাত্বে ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে লাউয়াছড়া। তবে কয়েক যুগ ধরে প্রভাবশালী মহলের বাধা, রক্তচক্ষু ও নানাবিদ কারণে বনটির প্রকৃত আয়তন পরিমাপ করতে পারেনি বন বিভাগ। তবে আশার বাণী হচ্ছে গত ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর বনবিভাগ কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত কিছু জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে আওয়ামীলীগের সাবেক কৃষি মন্ত্রী আব্দুস শহীদের দখলের কবল থেকে ৫ একর সহ মোট ১০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও লাউয়াছড়ার অন্যান্য ভূমিখেকোদের অবৈধ দখলে থাকা ভূমির বিষয়ে রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে বন বিভাগ। সূত্র বলছে লাউয়াছড়া বনের প্রায় ৭শ একর ভূমি ৩ যুগ আগেই প্রভাবশালীদের কব্জায় চলে গেছে ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্র্যে ভরপুর লাউয়াছড়া বনটিকে সরকার ১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা করে। কিন্তু গত ২৮ বছরেও বনের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি বন বিভাগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, লাউয়াছড়া বনটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার পূর্ব থেকেই বনটিতে দখলের থাবা বসিয়েছে একটি প্রভাবশালী মহল। নিজেদের জমির সঙ্গে বনের জমি দখলে নিয়ে বাড়িঘর তৈরি ও লেবু-আনারস-বাগানের সীমানা বর্ধিত করলেও প্রকৃতপক্ষে দখলের মহোৎসব শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো.আব্দুস শহীদ ২০০৮ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্পমূল্যে কিনে নিয়ে সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তোলেন। অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি নিজের কেনা স্বল্প জমির সঙ্গে কৌশলে লাউয়াছড়া বনের প্রচুর ভূমি  দখল করে চা-বাগানে যুক্ত করেছেন। সে সময় থেকেই বন বিভাগ বারবার জমি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েও করতে পারেনি। এরপর থেকেই মূলত লাউয়াছড়া বনভূমি দখলের মহোৎসবে মেতে ওঠে প্রভাবশালীরা।নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি দখল-বেদখলে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে প্রায় অর্ধেক আয়তনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকবার বনটি ডিমারকেশনের বা পরিমাপ করার চেষ্টা করেও অদৃশ্য কারণে ব্যার্থ হয়েছে বন বিভাগ। এমনকি সম্ভব হয়নি দখলবাজদের উচ্ছেদ করা। কারণ দখলবাজরা প্রায় সকলেই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী ব্যাক্তি। তাদের প্রভাবের কারণেই লাইয়াছড়া বনের ভূমি ডিমারকেশন বা পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালী এসব  দখলবাজদের ভয়ে তটস্থ থাকত খোদ বোন বিভাগই। 

উল্লেখ্য গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বন বিভাগ কিছুটা নড়েচড়ে বসে। শুরু করে বনের জমি উদ্ধারে ঝটিকা অভিযান । অভিযানে গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে চা-বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধার করে। গত ৩ নভেম্বর কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বদরুল আলমের দখলে থাকা প্রায় চার একর ভূমি উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।উদ্ধারকৃত ভূমিতে বন্য প্রাণীদের খাবার উপযুক্ত ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা হয়।

বন বিভাগ যে চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে সে জমিতে লেবু চাষ করতেন শাহ আলম নামে এক ব্যাক্তি। তিনি শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি জানান, বদরুল আলম জেনার নামের এক ব্যাক্তির কাছ থেকে ওই জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়ে লেবু চাষ করেছেন তিনি। অগ্রিম হিসেবে দুই বছরের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করার কথা ছিল।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবেশবাদী বলেন, ‘‘রক্ষিত বন এলাকার সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও এমন একটি কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বৃক্ষনিধন ও পাচার রোধ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক লাউয়াছড়ার বনভূমি অব্যাহত বেদখল বা জবরদখল রোধসহ বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। কিন্তু কমিটির সদস্য থাকা অবস্থায় বদরুল আলম জেনার নামে এক ব্যাক্তি নিজেই বনভূমি দখল করে নিয়েছেন। এ ছাড়া বনভূমি দখল করেছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদও। এককথায় বলা যায়, লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে ‘রক্ষকই ভক্ষক’। লাউয়াছড়া বনের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে ফেলার কারণে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তির দাবি জানান পরিবেশবাদীরা।’’ বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো.শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ দখলদার ছাড়াও স্থানীয় তিন থেকে চারশ লোক বাদী হয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ৩৭০ একর জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ও বন ডিমারকেশন না হওয়া পর্যন্ত ঠিক কতটুকু জমি অবৈধ দখলে রয়েছে, আর কতটুকু জমি বন বিভাগের আওতায় রয়েছে, তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বন ডিমারকেশন বা পরিমাপ করা হবে। ডিমারকেশন সম্পন্ন হলে প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে।’

সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দুই দফায় বনের নয় একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে বন্য প্রাণীর উপযোগী গাছের চারা লাগানো হয়েছে।’

 

লেখক : বৃক্ষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

রিপোর্টার :গাজী টেলিভিশন

Link copied!